শারীরিক এবং মানসিক ভাবে তাঁকে তো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়াই হয়েছিল। তবু, কী এক অদম্য সাহসে বিলকিস কিন্তু লড়াইটা ছাড়েননি। অনেক লড়াই, অনেক জিতে যাওয়ার গল্পকে পাশে রেখেও বিলকিস বানো একক, বিলকিস বানো আলাদা। তাঁর লড়াই শুধু একজন মানুষের জিতে যাওয়ার লড়াই নয়। বিলকিসের জয় একটা দেশের ন্যায়, নীতি, আইনের প্রতি আস্থা ফিরে আসার বাস্তবতা। সেই লড়াইকে ফিরে দেখলেন সরোজ দরবার।
দম বন্ধ হয়ে আসছিল তাঁর। নিজের ধর্ষকদের আশেপাশে ঘুরতে দেখলে কেই-বা আর স্বস্তিতে শ্বাস নিতে পারেন! নিজের দেশ যে তাঁর জন্য এমন পরিণতি বরাদ্দ করতে পারে, তা ভেবেও উঠতে পারেননি বিলকিস বানো। তবু হাল ছাড়েননি। ন্যায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। সামনে বিপদ আছে জেনেও, কী এক অদম্য সাহসে দেশ আর দেশের আইনের প্রতি ভরসা রেখেছিলেন। অবশেষে দেশের শীর্ষ আদালত যখন তাঁর ধর্ষকদের জেলে ফেরত পাঠানোর রায় দিল, তিনি বললেন, এখন যেন একটু শ্বাস নিতে পারছি। নিজের দেশে এই খোলা বাতাসে শ্বাসটুকু নেওয়ার জন্য কম লড়াই লড়তে হয়নি বিলকিসকে। সে লড়াই বোধহয় সিনেমার গল্পকেও হার মানায়।
আরও শুনুন: হিজাব বিতর্কের ভারতবর্ষে মনে থাকুক ‘অবরোধবাসিনী’দের হয়ে বেগম রোকেয়ার লড়াই
আসলে রূপকথা ভালোবাসে এই দেশ। হেরে যাওয়া মানুষের জিতে যাওয়ার গল্পের ভিতরই ঠাসা থাকে রূপকথা কিংবা অতিকথার উপাদান। সিনেমার পর্দা সেইসব জীবনকে সেলিব্রেট করে। দর্শক হিসাবে সকলেই যেন মনে মনে একটু জিতে যান সেই চরিত্রদের সঙ্গে। এই যেমন, সাম্প্রতিকের ‘টুয়েলফথ ফেল’ ছবির কথাই ধরুন। গ্রামের দেহাতি ছেলেটির আইপিএস অফিসার হয়ে ওঠার স্ট্রাগল যে বিপুল হাততালি কুড়িয়েছে, সে তো হেরে যাওয়া মানুষকে জিততে দেখার জন্যই। ‘টুয়েলফথ ফেল’-এর মনোজ শর্মাই হোন কি ‘মেরি কম’-এর হার-না-মানা বক্সার তরুণী, একেকজনের লড়াইটা একেকরকম। তা নিশ্চিতই সম্ভ্রম আদায় করে। কিন্তু বিলকিসের লড়াই! অনেক লড়াই, অনেক জিতে যাওয়ার গল্পকে পাশে রেখেও বিলকিস বানো একক, বিলকিস বানো আলাদা। তাঁর লড়াই শুধু একজন মানুষের জিতে যাওয়ার লড়াই নয়। বিলকিসের জয় একটা দেশের ন্যায়, নীতি, আইনের প্রতি আস্থা ফিরে আসার বাস্তবতা। যে ভরসা নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্রমশ কমতে থাকে। চারপাশে এমন সব ঘটনা আর তার পরিণতি আমরা দেখতে থাকি যে, একসময় লড়াই শব্দটাই যেন জীবনের অভিধানের বাইরে চলে যায়। মনে হয়, মুখ বন্ধ রাখাই বোধহয় শ্রেয়। মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের আর দ্বিতীয় কোনও উপায় নেই। ঠিক সেখানেই ব্যতিক্রম হয়ে ধরা দেন বিলকিস বানো।
আরও শুনুন: যৌনাঙ্গে লঙ্কাবাটা ঢুকিয়ে দেয় ব্রিটিশ পুলিশ, তবুও হার মানেননি প্রথম মহিলা রাজবন্দি ননীবালা
যে ভয়াবহতার ভিতর দিয়ে তিনি গিয়েছেন, তা কল্পনা করাও বোধহয় সাধারণের সাধ্যের অতীত। সেটা ২০০২ সাল, গুজরাট তখন গোধরার পরে হিংসার আগুনে জ্বলছে। আতঙ্কে তিন বছরের শিশুকন্যা আর জনা পনেরো আত্মীয়ের সঙ্গে গ্রাম ছেড়েছিলেন ২১ বছরের বিলকিস। তারপরেও শেষরক্ষা হয়নি। চোখের সামনে বাড়ির ১৪ জনকে নৃশংস ভাবে খুন হতে দেখেছিলেন। পাথরের উপরে আছড়ে ফেলে হত্যা করা হয়েছিল তাঁর তিন বছরের মেয়েকে। আর তিনি, বিলকিস বানো, পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন গণধর্ষিতা।
কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তকারীরা পরে জানিয়েছিলেন যে, বিলকিসের আত্মীয়দের এমনভাবে খুন করা হয়েছিল, যে, সবাইকে শনাক্ত পর্যন্ত করা যায়নি। কিন্তু হামলাকারীদের শনাক্ত করতে একটুও ভুল করেননি বিলকিস। সিবিআই জানিয়েছিল, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে গোটা ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। বারে বারে খুনের হুমকি এসেছে, সেই সবকিছুর পরেও লড়াই ছাড়েননি বিলকিস। সংখ্যালঘু মহিলা হিসাবে বিলকিসের লড়াইটা এমনিতেই কঠিন ছিল। শারীরিক এবং মানসিক ভাবে তাঁকে তো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়াই হয়েছিল। তবু, কী এক অদম্য সাহসে বিলকিস কিন্তু লড়াইটা ছাড়েননি। দীর্ঘ আইনি পথ পেরিয়ে তাঁর ১২ জন ধর্ষকের কারাদণ্ডটুকু নিশ্চিত হয়েছিল।
তবে, বিলকিস বানোর লড়াইয়ের গল্পটা কিন্তু এখানেই ফুরিয়ে যায়নি।
দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছরের উদযাপনে, বিলকিসের ধর্ষকদের মধ্যে জীবিত ১১ জনই বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। অবাক হয়েছিলেন বিলকিস। দম বন্ধ হয়ে এসেছিল তাঁর। কিন্তু গোটা দেশ? না, তেমন ভাবে কথা বলে ওঠেনি। যে দেশ নির্ভয়াকাণ্ড দেখেছে, মোমবাতি মিছিল করেছে, যে দেশ হাথরাসে ধর্ষণের ভয়াবহতায় মুহ্যমান হয়ে পড়েছে, সেই দেশেরই গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ কিন্তু এবার প্রতিবাদে সরব হয়নি সেভাবে। বিলকিস দেখেছিলেন, তাঁর ধর্ষকদেরই মালা পরিয়ে বরণ করে নিচ্ছে সমাজ। এবারও কিন্তু লড়াই ছাড়লেন না বিলকিস। আবারও বিপদ আছে জেনেও চালিয়ে গেলেন লড়াই। সেই আইনি পথেই। বিলকিস বোধহয় জানতেন, অন্যায় মেনে নেওয়া এই দেশ এখনও পুরোপুরি রপ্ত করে উঠতে পারেনি। যে পরিস্থিতিতে দশজনে ন-জনই হাল ছেড়ে দিতেন, হয়তো চলে যেতেন অজ্ঞাতবাসে, সেই সময়েই ফের সামনে এসে বিলকিস জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন লড়াইয়ের মশাল।
বিলকিসের লড়াই তাই এককের হয়েও, একার নয়। তা একদিকে সমষ্টির বিরুদ্ধে একের লড়াই। আবার বর্তমান পরিস্থিতিতে যে প্রতিবাদী স্বরই আসলে সংখ্যালঘু, সেই সংখ্যালঘুদের সম্মিলিত স্বরই যেন বিলকিস বানো। আর তাই বর্তমান ভারতবর্ষে অন্য মাত্রা পেয়েছে বিলকিস বানোর লড়াই। সিনেমার পর্দায় যে লড়াই আর জিতে যাওয়ার গল্প আমরা দেখে থাকি, তার থেকে এই বাস্তব অনেক আলাদা। বোধহয় সেই সব ব্যক্তিগত লড়াইয়ের কাহিনি বিলকিসকে স্পর্শও করতে পারে না। কেননা ‘বজ্রানলে আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’ লড়াই করার ক্ষমতা সকলের থাকে না।
যাঁর থাকে, তাঁর নামই হয়ে ওঠে বিলকিস বানো।