তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় সিনেমা পেয়েছিল সিনেমাটোগ্রাফির দুনিয়ায় প্রথম মহিলাকে। শুধু ভারত নয় গোটা এশিয়ার প্রথম মহিলা সিনেমাটোগ্রাফারও তিনি। নাম তুলেছেন লিমকা বুক অব রেকর্ডেও। তিনি বি আর বিজয়লক্ষ্মী। দক্ষতার সঙ্গে অসংখ্য তামিল ছবির নেপথ্যে কাজ করে গিয়েছেন একের পর এক। করেছেন নির্দেশনাও। তামিল টিভি শো-তেও রয়েছে তাঁর বিরাট অবদান। আসুন, শুনে নিই তাঁর গল্প।
‘ডিয়ার জিন্দেগী’ ছবিতে আলিয়া ভাটের চরিত্রটি মনে আছে নিশ্চয়ই। ওই ছবিতে আলিয়া ছিলেন একজন সিনেমাটোগ্রাফারের ভূমিকায়। কিন্তু নিজের পেশার কথা মানুষকে বোঝাতে রীতিমতো নাকানিচোবানি খেতে হত তাঁকে। ব্যাপারটা নিয়ে বেজায় চটেও যেত সে।
সত্যিই সিনেমাটোগ্রাফার ব্যাপারটা যে আসলে কী, তা হয়তো এখনও অনেকেই জানেন না। আমরা সিনেমা দেখি বটে। তবে ক্যামেরার পিছনের কলাকুশলীদের খোঁজ রাখি না। সিনেমা শেষে পর্দা জুড়ে ওই সব খুদে খুদে অক্ষরে লেখা টাইটেল প্লেট পড়ার ধৈর্য্যও থাকে না। ফলে পর্দা আর পরিচিতি দুটোরই আড়ালে থেকে যান নেপথ্যের কলাকুশলীরা। অথচ ছবি জুড়ে তাঁদের অবদানই অভিনেতা বা নির্দেশকের চেয়ে বোধহয় কোনও অংশেই কম নয়। সিনেমাটোগ্রাফার তথা চিত্রগ্রাহক। এমনিতেই নেপথ্যের এই কাজ নিয়ে চর্চা কম। ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ট্রলিতে চেপে ছবি তুলছেন মেয়েরা। এ ছবিটা আজও বোধহয় খুব একটা পরিচিত নয়। এসব কাজে পুরুষদেরই বেশি দেখে অভ্যস্ত দুনিয়া। তবে সেই সব ধারনা ভেঙেছেন পর্দার কায়রার মতো অনেক মেয়েরাই। তবে ভারতীয় সিনেমায় সেই শুরুটা হয়েছিল যাঁর হাত ধরে, তিনি বি আর বিজয়লক্ষ্মী। শুধু ভারতীয় সিনেমাতেই নয়, সমগ্র এশিয়াতেই তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা সিনেমাটোগ্রাফার।
আরও শুনুন: ছক ভেঙেছিলেন উমাদেবী, তিনিই ভারতীয় সিনেমার প্রথম মহিলা কমেডিয়ান
বাবা বি আর পানথুলু তামিল ছবির একজন নামকরা পরিচালক। একজন ইনটেরিয়ার ডিজাইনার হিসেবেই কেরিয়ার শুরু করেছিলেন বিজয়লক্ষ্মী। প্রিয় বন্ধু সুহাসিনী তখন নামী অভিনেত্রী। তাঁর সূত্রেই পরিচয় হয় প্রখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার অশোক কুমার আগরওয়ালের সঙ্গে। তাঁর হাত ধরেই রূপোলি পর্দায় আসা। ১৯৮০ সাল থেকে অশোক কুমারের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করলেন বিজয়লক্ষ্মী। উত্তরপ্রদেশের মানুষ অশোককুমার তামিল ভাল বুঝতে পারতেন না। সেটে তাঁর অনুবাদক হিসেবেও কাজ করতেন বিজয়লক্ষ্মী। ১৯৮৫ সালে ‘ছিন্না বীরু’ সিনেমা দিয়ে প্রথম স্বাধীন সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন বিজয়লক্ষ্মী। তার পর কম করে হলেও ২২টি ফিচার ছবিতে ক্যামেরার কাজ করেছেন তিনি এই সময়ে।
এরই মধ্যে ১৯৯২ সালে একটি মালয়লম ছবির চিত্রনাট্যও লিখে ফেলেন তিনি। ১৯৯৫ সালে ছবি নির্দেশনার কাজে পা বাড়ালেন বিজয়লক্ষ্মী। সেই ছবির চিত্রনাট্য এবং ক্যামেরাও অবশ্য করেছিলেন তিনি নিজেই। তাঁর সেই ছবিটি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়াতেও দেখানো হয়েছিল। শুধু বড় পর্দা নয় , সমান তালে কাজ করেছেন ছোট পর্দাতেও। তামিল টিভি শো-তে কম্পিউটার গ্রাফিক্স নিয়ে এসেছিলেন তিনিই প্রথম।
আরও শুনুন: ডিঙিয়েছেন বাধার পাহাড়, নিষিদ্ধপল্লী কামাথিপুরা থেকে পড়াশোনার জন্য বিদেশে পাড়ি এই ভারতকন্যার
তবে বিয়ের পরেই সিনেমার জগতে ইতি টানেন বিজয়লক্ষ্মী। শুরু করেন নতুন যাত্রা। আপাতত একটি নামী মিউজিক সংস্থায় উঁচু পদে কর্মরত বিজয়লক্ষ্মী। পেরিয়েছেন ষাটের কোঠা। তিনি সিনেমা ছাড়লেও সিনেমা তাঁকে ছাড়েনি। ২০১৮ সালে ফের একটি তামিল ছবিতে নির্দেশনার কাজ করেন বিজয়লক্ষ্মী।
নিজের কাজকর্ম, প্রথম মহিলা সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশেষ কথা বলতে পছন্দ করেন না তিনি। স্কুল খুলে এসব কাজ শেখানো যায় বলেই বিশ্বাস তাঁর। বিজয়লক্ষ্মী জানান, তাঁরা যে সময়টায় কাজ করেছেন, সেটা সেলুলয়েডের যুগ। আজকালকার মতো এত সুযোগ-সুবিধা সে সময় ছিল না। একটা শট নেওয়ার পরেই রিওয়াইন্ড করে সেটা দেখা যেত না সে সময়ে। ফলে সিনেমাটোগ্রাফারের সঙ্গে ছবির পরিচালক ও নির্দেশকের তালমিলটাই ছিল আসল কথা। এমনটাই মত বিজয়লক্ষ্মীর। এশিয়ার প্রথম সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে লিমকা বুক অব রেকর্ডেও নাম রয়েছে তাঁর। ভারতীয় সিনেমায় তিনি সামান্য হলেও যে অবদান রাখতে পেরেছেন, সেটাই আত্মতুষ্টি বিজয়লক্ষ্মীর।