দেশ মায়ের জন্য কি কেবল তাঁর ছেলেরাই প্রাণ দিতে পারেন, মেয়েরা নয়? নিজের জীবন দিয়ে এ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গিয়েছিলেন এক বীরাঙ্গনা। তিনি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। মৃত্যুদিনে আরও একবার ফিরে দেখা যাক প্রীতিলতাকে।
যে কোনও বিপ্লবে, যে কোনও সংগ্রামে, কোনও না কোনও ভাবে শরিক হন অনেকেই। কিন্তু যাঁরা সে দলের পুরোভাগে থাকেন, তাঁদের কথা তাও শোনা যায়। হারিয়ে যান আড়ালে থাকা মানুষেরা। মানুষের ইতিহাসে এই হারিয়ে যাওয়ার নিয়তি বারে বারে ফিরে ফিরে এসেছে মেয়েদের জন্য। যেহেতু সমাজের নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘদিন ধরেই ছিল পুরুষের হাতে, আর নারীর জন্য বরাদ্দ ছিল অন্দরমহল, ফলে সেই অন্দরের আড়াল থেকে মেয়েদের দেখতে পাওয়াও সহজ ছিল না। নজরুল লিখেছিলেন,
“কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।”
তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, পুরুষের তরবারি কখনোই একা জয়ী হয়নি। তাকে শক্তি জুগিয়েছে নারীও। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আসলে এমনই চোখের আড়ালে পড়ে গিয়েছিলেন অনেক নারী। যাঁরা চোখের জল চেপে স্বামী পুত্রকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, বিপ্লবীদের সাহায্যও করেছেন সর্বতোভাবে, কিন্তু তাঁদের কথা হারিয়েই গিয়েছে। কিন্তু কখনও কখনও নিজের কথা বলার দরকার হয়। আরও অনেককে অনুপ্রেরণা জোগাবার জন্য নিজের কথা বলতে হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে যখন আরও অনেক বলিদানের দরকার, তখন সেই কথাটিই বুঝেছিলেন এক বীরাঙ্গনা। সম্মুখ সমরে নামার আগের দিন অজ্ঞাতবাস থেকে শেষবারের জন্য মাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন তিনি। মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে জানিয়েছিলেন, আর ফিরে আসবেন না। কারণ, দেশ মাকে মুক্তি দিতে অনেক পুত্র প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু কোনও কন্যা এখনও প্রাণ দেয়নি। তাঁদের অনুপ্রেরণা দিতেই মৃত্যুবরণ করছেন তিনি, জানিয়েছিলেন সেই মেয়ে। তিনি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
আরও শুনুন: যৌনাঙ্গে লঙ্কাবাটা ঢুকিয়ে দেয় ব্রিটিশ পুলিশ, তবুও হার মানেননি প্রথম মহিলা রাজবন্দি ননীবালা
চট্টগ্রামে জন্মানো এই মেয়েটি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী। ১৯৩০ সালে তিনি আইএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম ও সবার মধ্যে পঞ্চম হন। কিন্তু ততদিনে তাঁর মধ্যে দেশপ্রেমের বীজ বুনে দিয়েছেন মা প্রতিভা, আর স্কুলের শিক্ষিকা ঊষাদি ও নীলিমাদি। প্রীতিলতার আত্মীয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার বিপ্লবী দলের কর্মী ছিলেন। তিনি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত কিছু গোপন বই প্রীতিলতাকে রাখতে দিয়েছিলেন। আর সেখান থেকেই প্রীতিলতা লুকিয়ে পড়ে ফেলেন বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম আর কানাইলালের জীবনের কথা। তখন তিনি সবে দশম শ্রেণির ছাত্রী। এইভাবেই তাঁর ভবিষ্যতের পথ ক্রমশ নির্দিষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তখনও পর্যন্ত বিপ্লবী দলে মহিলা সদস্য গ্রহণ করা হয়নি। প্রীতিলতা যখন ঢাকায় পড়তে যান, তখন ‘শ্রীসঙ্ঘ’ নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন ছিল, যার একটি মহিলা শাখা ছিল ‘দীপালি সঙ্ঘ’। লীলা নাগের নেতৃত্বে পরিচালিত এই সংগঠনে প্রীতিলতা যোগ দেন। লাঠি খেলা, ছোরা খেলা শেখেন। আত্মকথায় লিখেছিলেন, আইএ পড়ার জন্য যে দুবছর ঢাকায় ছিলেন, তখন নিজেকে মাস্টারদার উপযুক্ত শিষ্য হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টাই তিনি করছিলেন। আর সেই মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত দেখা করতে এলেন তিনি। সেই প্রথম দেখা হওয়ার কথা লিখেছেন মাস্টারদা নিজেই, “তার চোখেমুখে একটা আনন্দের আভাস দেখলাম, এতটা পথ হেঁটে এসেছে তার জন্য কোনও ক্লান্তির চিহ্নই দেখলাম না।” মাস্টারদাকে রাজি করিয়ে দলে যোগ দিলেন প্রীতিলতা। বাবার চাকরি নেই, বাড়িতে একমাত্র রোজগেরে তিনিই, তাঁর স্কুলের চাকরিই তখন সংসারের হাল ধরেছে। এই অবস্থায় বিপ্লবীদের দলে নাম লেখানো সহজ ছিল না, কিন্তু সব বাধাকেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রীতিলতা।
সেই যে বিপ্লবীদের পাশে দাঁড়ানো আড়ালের মেয়েদের কথা হচ্ছিল, তেমনই একজন ছিলেন সাবিত্রী দেবী। বিধবা এই নারী সমাজের তোয়াক্কা না করে, পুলিশের ভয় না করে আশ্রয় দিতেন পলাতক বিপ্লবীদের। সেখানেই অনেক আক্রমণের পরিকল্পনা কষেছিলেন সূর্য সেন। সেখানেই ১৯৩২ সালের ১২ জুন, প্রীতিলতাকে ডেকে পাঠালেন সূর্য সেন। সেখানে তখন নির্মল সেন, ভোলা সেনরা রয়েছেন, পুলিশের চোখে যাঁরা ভয়ংকর বিপ্লবী। আর সেই খবর পেয়েই সেখানে পরদিন হানা দিল পুলিশ। সংঘর্ষে প্রাণ হারালেন নির্মল ও ভোলা দুজনেই। মাস্টারদা ও প্রীতিলতা প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলেন বটে, কিন্তু স্কুল ছেড়ে এবার আত্মগোপন করতে হল প্রীতিলতাকেও।
আরও শুনুন: গৃহবধূ থেকে বিপ্লবী, অস্ত্র আইনে প্রথম সশ্রম কারাদণ্ড হয় দুকড়িবালা দেবীর
এর কয়েক মাস পরেই ইউরোপিয়ান ক্লাবে বোমা ছোড়ার ঘটনায় নেতৃত্ব দেন প্রীতিলতা। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পুরুষের পোশাক পরে চট্টগ্রামের ইউরোপিয়ান ক্লাবে হানা দিলেন প্রীতিলতা, যেখানে লেখা থাকত, কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ। ক্লাবের সাহেব-মেমরা তখন নাচ-গান আর খানাপিনায় মত্ত। হঠাৎ গোটা ক্লাবঘর কেঁপে উঠল প্রচণ্ড বিস্ফোরণে। সেই সঙ্গে গর্জে উঠল কয়েকটি পিস্তল, সঙ্গে বিপ্লবীদের গলায় গর্জন, ‘বন্দে মাতরম্’। অভিযান সফল হল। কিন্তু দলনেত্রী? পটাশিয়াম সায়ানাইডের ক্যাপসুলটা দাঁতে চেপে পড়ে রইলেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলির মাটিতে, কুড়ি বছরের প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। নিজের প্রাণ দিয়ে আরও মেয়েদের সামনে দেশের জন্য আত্মবলিদানের পথ খুলে দিয়ে গেলেন এই বীরাঙ্গনা।