‘সাউন্ড অফ মিউজিক’ সিনেমার সেই সন্ন্যাসিনীকে মনে আছে? যাঁর সুরে মঠের নিয়ম মানা কঠোর জীবনযাত্রায় জেগে উঠত প্রাণের ইশারা! তেমনই এক সন্ন্যাসিনী অনি চোয়িং ড্রলমা। পৃথিবীর প্রথম বৌদ্ধ রকস্টার বলা হয় তাঁকে। এখনও পর্যন্ত ১৪টি গানের অ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে তাঁর। তাঁর সঙ্গে গান গেয়েছেন খোদ এ আর রহমান। একসময় যে গান ছিল তাঁর পূজার উপকরণ, এখন সেই গানকেই লড়াইয়ের হাতিয়ার করে তুলেছেন এই ‘সিঙ্গিং নান’। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সেই আশ্চর্য লড়াইয়ের গল্প।
না, কোনও বৈরাগ্যের প্রেরণায় সন্ন্যাস নেয়নি মেয়েটি। সে সন্ন্যাসিনী হয়েছিল স্রেফ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে। যাতে মায়ের মতো তাকেও রোজ পড়ে পড়ে মার খেতে না হয়। কাঠমান্ডুর অজ পাড়াগাঁয়ের গরিব সংসারে বেড়ে ওঠা মেয়েটি জানত, এটাই রীতি। মেয়েদের সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয় আর মার খেতে হয়। বাবা-ই হোক বা স্বামী, যে কারও অধিকার আছে তাদের মারতে মারতে আধমরা করে ফেলার। তাই মাত্র তেরো বছর বয়সে মায়ের হাত ধরে সে হাজির হয়েছিল কাঠমান্ডুর ‘নাগি গুমফা’তে। মাথা কামিয়ে, গেরুয়া পরে, বেছে নিয়েছিল সন্ন্যাসিনীর জীবন।
আরও শুনুন: দেবদাসী হওয়ার ভাগ্যলিপি বদলে হলেন চিকিৎসক, দেশের প্রথম মহিলা বিধায়ক তিনিই
না, সন্ন্যাসিনী হওয়ার দরুন জীবনের অনেক কিছু হারিয়ে গিয়েছে বলে মনেই হয়নি তার। বরং এতদিনে যেন মানুষের মতো একটা জীবনে বাঁচছিল সে। যেখানে খাবার জোটে রোজ। গালিগালাজ কিংবা মারধর সহ্য করতে হয় না। ছোট ভাইকে পিঠে বেঁধে পাহাড়ে চড়তে হয় না। নেই আগের মতো হাড়ভাঙা খাটুনিও। তবে তখনও যে আরও অনেক কিছু পাওয়ার আছে তার, সে কথা জানত না সেই তেরো বছরের কিশোরী, অনি চোয়িং ড্রলমা। সে কথা জানার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও নটা বছর। আর ন’বছরের মাথায়, ১৯৯৩ সালে ওই গুম্ফায় এসেছিলেন মার্কিন রেকর্ড প্রোডিউসার স্টিভ টিবেট।
আরও শুনুন: আশি পেরিয়েও নিশানা নিখুঁত ‘রিভলবার দাদি’-র, বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক শার্প শ্যুটার এই মহিলা
এক সন্ধেবেলায় প্রার্থনার সময়ে ড্রলমার গলায় গান শুনতে পান স্টিভ। তিব্বতি মহামন্ত্র “ওম মণিপদ্মে হুম্”-এর সুর যে এমন করে প্রাণকে ছুঁয়ে যেতে পারে, আগে কখনও তা বোঝেননি তিনি। তাঁর মনে হয়, পূজার বেদিতে নয়, ওই সুরেই বাস স্বয়ং দেবী প্রজ্ঞাপারমিতার। ড্রলমার গুরুর কাছে গিয়ে এই গান রেকর্ড করার অনুমতি আদায় করেন স্টিভ। যদিও মুগ্ধতার ধাক্কায় প্রথমে রেকর্ডার অন করতেই ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। তবে শেষমেশ দুটি গান রেকর্ড করতে পারেন স্টিভ। আর সেই গান তিনি পাঠিয়ে দেন বিখ্যাত সংগীতজ্ঞদের কাছেও। সকলের প্রতিক্রিয়া পেয়ে আর দেরি করেননি ওই রেকর্ড প্রোডিউসার, সোজা অ্যালবাম রেকর্ড করার প্রস্তাব দেন ড্রলমাকে। আর প্রথম অ্যালবামেই বাজিমাত। জন্ম হয় ‘সিঙ্গিং নান’-এর, বৌদ্ধ দুনিয়ার প্রথম রকস্টারের।
প্রথম অ্যালবামের সূত্রেই, জীবনে প্রথমবার কাঠমান্ডুর বাইরে পা রেখেছিলেন এই মেয়েটি। আমেরিকা থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে সেখানে পরপর ২২টি শহরে লাইভ অনুষ্ঠান করেন ড্রলমা। আর একইসঙ্গে বদলে যায় তাঁর এতদিনের জীবনটাও। এতদিনের চেনা গণ্ডিতে কেবল পড়ে পড়ে মার খাওয়া মেয়েদের দেখেছিলেন তিনি। ওই জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সন্ন্যাসিনী হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় তিনি দেখতে পাননি। কিন্তু বিদেশে শিক্ষিত, স্বনির্ভর মেয়েদের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর দেখার চোখটাই বদলে গেল। দেশে ফিরে স্বোপার্জিত অর্থ দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন “নান’স ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন” আর একটি মেয়েদের বোর্ডিং স্কুল। দেখতে দেখতে এই ‘সিঙ্গিং নান’-এর ১৪টি অ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে। দলাই লামার আত্মজীবনীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিক্রি হয় ড্রলমার ৩৭ বছর বয়সে লেখা আত্মজীবনী- ‘সিঙ্গিং ফর ফ্রিডম’। আর এই সব টাকাই তিনি ব্যয় করেন নিজের দেশের মেয়েদের শিক্ষার জন্য। জনকল্যাণমূলক কাজের সুবাদে মার্কিন মুলুকে ড্রলমার নতুন নাম- ‘আ মাদার টেরেসা ইন মেকিং’।
ড্রলমা এখন বলেন, তাঁর মা যদি লেখাপড়া জানতেন, নিজে উপার্জন করতে পারতেন, তবে ওই মার-খাওয়া জীবনটা তাঁর হত না। মায়ের ক্ষেত্রে যা সম্ভব হয়নি, দেশের বাকি মেয়েদের জীবনে তা-ই সত্যি করে তুলতে চান এই সন্ন্যাসিনী। আর সেই চলার পথে গান-ই তাঁর অস্ত্র, গান-ই তাঁর দিশারী।