কর্মরতাদের সম্পর্কে ভারতীয় পুরুষ-সমাজের মনোভাব আসলে কেমনটা? এখানেই আসলে মূল সংকট। দেখা যাচ্ছে, কর্মরতা মহিলাকে নিয়ে সমাজের আপত্তি নেই। কিন্তু এখনও সমাজের গড় ধারণা এই যে, তিনি কাজের থেকে পরিবারের কাজকে প্রথম জায়গায় অর্থাৎ ফার্স্ট প্রায়োরিটিতে রাখুন। অর্থাৎ ঘর সামলে বাইরের কাজ যদি করতে পারেন, তাহলে কোনও কথা নেই। আবার একই সঙ্গে গৃহশ্রম শ্রমের মর্যাদাহীন। এই দ্বিমুখী সংকটের মধ্য দিয়েই দিন অতিবাহিত করেন দেশের অধিকাংশ কর্মরতা।
ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম। করোনাকালে ভারতবর্ষ কাজের এই পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে। মহামারী শেষে আবার সকলে কাজের জায়গায় ফিরে গিয়েছেন। কোনও কোনও সংস্থা আবার ঝুঁকেছে হাইব্রিড মডেলের দিকে। এর মধ্যেই নয়া চিন্তাভাবনা করছে অন্ধ্রপ্রদেশ। কোভিড বা কোনও দুর্বিপাক না থাকলেও সেখানে ওয়ার্ক-ফ্রম-হোমের সুবিধা বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে। লক্ষ্য অবশ্যই কর্মরতারা।
সে-রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাড়ি থেকে কাজের সুবিধা থাকলে, কর্মরতাদের অংশগ্রহণ অনেকাংশে বাড়বে। অতএব এই সদর্থক পদক্ষেপের দিকেই এগোতে চাইছে রাজ্য। সম্প্রতি, কাজ আর ব্যক্তিজীবনের ভারসাম্য নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, সেই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় সকলকেই। তবে, মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যার মাত্রা একেবারেই অন্যরকম। বিশেষত ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় মহিলাদের যে যে ভূমিকা পালন করতে হয়, সেখানে কেরিয়ারের দিকে নজর যেন তাঁরা সেভাবে দিতে পারেন। যাঁরা দেন, অর্থাৎ যাঁরা কর্মরতা, তাঁরাও অহরহ এই ভারসাম্য রক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কেরিয়ারের থেকে পরিবারকেই গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। সেই নিরিখে যদি বাড়ি থেকে কাজের সুবিধা থাকে, তাহলে যে সামগ্রিক ভাবে কর্মরতাদের অংশগ্রহণ বাড়বে, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। সম্প্রতি আর এক সমীক্ষা জানিয়েছে যে, কর্মরতাদের ক্ষেত্রে সেরা শহরের তকমা পেয়েছে বেঙ্গালুরু। অর্থাৎ কর্মরতাদের সুবিধার দিকে যে রাজ্যগুলো পৃথক ভাবে নজর দিচ্ছে তা সাধারণ ভাবে বলা যায়।
আরও শুনুন: ন্যাড়া মাথাতেই বিয়ের পিঁড়িতে কনে, বাকিরাও কি মনোবল পাবেন?
তবে, সেই একই প্রশ্নের অভিমুখ যদি ভারতীয় সমাজের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে ধন্দ জাগে। সময়টা ২০২৫। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এসে মানুষের হাতের কাজ কেড়ে নেবে কি-না তা নিয়ে আলোচনা সর্বত্র। প্রগতির এই সংকটের সময়েও মহিলাদের কাজ নিয়ে ভারতীয় সমাজের, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মন কি আদৌ বদলেছে? তা একটি তর্কযোগ্য বিষয়ই বটে। যদিও তথ্য-পরিসংখ্যান বলবে যে, কর্মরতাদের সংখ্যা বেড়েছে। অন্তত গত এক দেড় দশকে তো বটেই। অর্থাৎ এই সময়পর্বে গৃহবধূ আর কর্মরতাদের মধ্যে ভারতীয় পুরুষ যদি কর্মরতাদের গুরুত্ব দিতে শেখে, তাহলে দুটো বিষয় স্পষ্ট হয়। এক, মহিলারা যে কাজ করবেন, এবং তা যে সঙ্গত, এই চিন্তার স্বাভাবিকতায় সমাজ খানিকটা হলেও এগিয়েছে।
তবে, এক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিষয়টি আরও ভাবিয়ে তোলার মতো। তা হল, গৃহশ্রমকে এখনও শ্রমের মর্যাদা দিতে শেখেনি এই সমাজব্যবস্থা। অথচ ভারতীয় পরিবার-প্রথা তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়বে এই শ্রম সরিয়ে দিলে। তা জেনে এবং বুঝেও গৃহশ্রমকে খাটো করে দেখার রেওয়াজ থেকে গিয়েছে। এবং অর্থনীতির সঙ্গে তার যে যোগাযোগ রচিত হয়নি তা স্পষ্ট। অথচ গৃহশ্রমকে যদি কাজ হিসাবে যথোপযুক্ত গুরুত্ব দেওয়া হত, তাহলে এক একজন মহিলা যে সিইও হিসাবে গণ্য হতেন তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। অতএব কর্মরতা ও গৃহবধূদের নিয়ে আলোচনা যখন উঠবে, যখন এই নিয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনা হবে, তখন এই গৃহশ্রমের দিকটিকে গুরুত্ব দিয়ে না দেখা ছাড়া উপায় থাকে না। কর্মরতার সংজ্ঞা তাই যদি এক্ষেত্রে আরও প্রসারিত করে দেখতে পারে সমাজ তাহলেই মঙ্গল।
আরও শুনুন: সাজে পারফেক্ট, কাজে নিখুঁত! গুড-গার্ল-সিন্ড্রোমেই ইতি টানছেন ভারতীয় নারীরা
এবার যদি অফিসে কর্মরতাদের কথা ধরা হয়, তাহলেও সমাজব্যবস্থার বদল কতখানি? তথ্য দিয়ে সবটা বোঝা যায় না। কেননা একজন কর্মরতাকে ঘরে-আর বাইরে যে মাত্রার চাপ সামলাতে হয়, তা সামলাতে হয় না একজন পুরুষকে। এই চাপের বেশিরভাগটাই নির্ধারিত হয় সমাজব্যবস্থার কারণে। পরিবার, সংসার, আর কাজ-কে একই গুরুত্ব দিয়ে সামলাতে হয় তাঁদের। এই সমাজে মহিলারা যে এই ব্যবস্থায় খুব একটা ছাড় পান, তা কিন্তু নয়। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। তবে ব্যতিক্রম তো আর সাধারণকে চিহ্নিত করে না। ফলত, এখনও যখন কর্মরতাদের অনেক সময় কেরিয়ার ছেড়ে পরিবারকে বেছে নিতে হয়, তখন প্রশ্ন জাগে, কর্মরতাদের সম্পর্কে ভারতীয় পুরুষ-সমাজের মনোভাব আসলে কেমনটা? এখানেই আসলে মূল সংকট। দেখা যাচ্ছে, কর্মরতা মহিলাকে নিয়ে সমাজের আপত্তি নেই। কিন্তু এখনও সমাজের গড় ধারণা এই যে, তিনি কাজের থেকে পরিবারের কাজকে প্রথম জায়গায় অর্থাৎ ফার্স্ট প্রায়োরিটিতে রাখুন। অর্থাৎ ঘর সামলে বাইরের কাজ যদি করতে পারেন, তাহলে কোনও কথা নেই। আবার একই সঙ্গে গৃহশ্রম শ্রমের মর্যাদাহীন। এই দ্বিমুখী সংকটের মধ্য দিয়েই দিন অতিবাহিত করেন দেশের অধিকাংশ কর্মরতা।
এই পরিস্থিতিই বোধহয় মহিলাদের জন্য ওয়ার্ক-ফ্রম-হোমের সুবিধা আনার কথা ভাবতে বাধ্য করে। তা সদর্থক পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে। তবে, তাও কিন্তু আদতে ঘর আর বাইরে সামলানোর একটা মধ্যপন্থাই। কাজ হোক বা পরিবার, মহিলারা নিজেদের মতো করে তাঁদের প্রায়োরিটি নির্বাচন করুন। এই অভিমুখে সমাজের মন না বদলালে পরিস্থিতির বদল হবে না। তবে তা কতদিনে বা কত যুগে সম্ভব, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। ফলত যে কোনও পদক্ষেপ, তা যত ছোটই হোক না কেন, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কর্মরতাদের ক্ষেত্রে।