নারীর অধিকার আদায়ের ইতিবৃত্ত সহজ ছিল না কোনোদিনই। বহু সংগ্রাম, বহু ঘাম-শ্রমের গল্প জড়িয়ে আছে সেই পথের ধুলোয়। এই ধুলোপথের নুড়িপাথর যাঁরা সরাতে অগ্রণী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম কমলা ভাসিন। নারীপ্রগতি, লিঙ্গসাম্য নিয়ে তাঁর ভাবনা ভাষা ও সাহস দিয়েছে বহুজনকে।
হাম ভারত কি নারী হ্যায়, ফুল নেহি , চিঙ্গারি হ্যায় – তাঁর মুখের কথাই হয়ে উঠেছিল সকলের মনের কথা। ভারতবর্ষ মাতৃপূজার দেশ। আবার বিপরীত ভাবে, এ দেশে নারীর উপর অত্যাচারের ঘটনাও কম নয়। বরং দিনে দিনে তা বাড়ছে। একদিকে প্রগতিশীলতার ঝকঝকে প্রচ্ছদ, অন্যদিকে পিতৃতান্ত্রিকতার ছড়িয়ে থাকা জাল। এই বড় দেশটায় এ সবই থাকে পাশাপাশি। এই দেশে তাই নারীর অধিকার, নারী প্রগতির আন্দোলনকে দিশা দেখানো সহজ কাজ নয়। সেই কঠিন কাজটিতেই অগ্রণী হয়েছিলেন কমলা ভাসিন। আমির খানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি সাফ বলেছিলেন, কোনও নারীকে হেনস্তা করা হলে, ধর্ষণ করা হলে বলা হয় তাঁর সম্মানহানি হল। কিন্তু নারীর সম্মান যোনিতে রাখল কে! আমি তো কখনোই মনে করি না যে আমার সম্মান আমার স্ত্রী-অঙ্গেই গচ্ছিত রাখা আছে।
আরও শুনুন:
মেয়েদের দাম কত! শাসক থেকে বিরোধী, সব পথ শেষে মিলে যায় একই প্রশ্নে?
নারী আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার হল ভাবনায় ধার দেওয়া। এই কাজটি সযত্নে লালন করার চেষ্টা করেছিলেন কমলা। ছড়িয়েও দিয়েছিলেন সকলের মধ্যে। তিনি জানতেন, দীর্ঘদিনের জাঁকিয়ে বসা পিতৃতান্ত্রিকতার এই যে জাল, তাকে একদিনে সরিয়ে ফেলা যায় না। কিংবা গায়ের জোরেও তাকে হটানো যায় না। দরকার, ভাবনার অভিমুখ বদল। সবার আগে তাই তিনি বলতেন, নারীবাদ মানে কখনই পুরুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা নয়। পুরুষ নারীর বিবাদ বা লড়াই নারীবাদের কাম্য নয় কোনোদিনই। নারীবাদ আসলে বলে, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। অর্থাৎ, প্রকৃতপক্ষে তা দুই ঘরানার ভাবনার লড়াই। এই শাণিত যুক্তিই বহু নারী এবং পুরুষকেও বের করে এনেছিল ভাবনার সীমাবদ্ধতা থেকে। সামান্য পুরুষ-নারীর বিবাদের মধ্যে নারীবাদকে আটকে না রেখে বৃহত্তর আন্দোলনের জমি গড়ে তুলেছিলেন কমলা ভাসিন। আর তাঁর জন্য সবার আগে বদলে দিয়েছিলেন সকলের ভাবনার আকাশটিকেই। একাধারে তিনি নারীপ্রগতি আন্দোলনের কর্মী, সংগঠক আবার তিনি ছিলেন কবিও। মহিলাদের অধিকার অর্জনের জন্য হাতে-কলমে বহু কাজও করেছেন। দক্ষ সংগঠক ছিলেন তিনি। শান্তির বার্তা নিয়ে কাজ করেছেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। তবে, কমলা ভাসিনের প্রভাব আসলে ওই সমাজের সামগ্রিক ভাবনার মানচিত্র বদলে। হাসিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, অনেকসময় পুরুষতান্ত্রিকতাকে বাঁচিয়ে রাখতে ধর্মকেও ঢাল করা হয়। কোনও কিছু নিয়ে প্রশ্ন তুললে বলা হয় যে, এ তো আমাদের রীতি ও সংস্কার। অর্থাৎ, যেখানে যুক্তি আর থই পায় না, সেখানে বিশ্বাস-সংস্কার এসে রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়ায়। আসলে ভাবনার এই তীক্ষ্ণ আলোয় মাধ্যমে আমাদের চিন্তাজগতের কুয়াশা মুছে দিতেই বারবার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। আর তাই চেয়েছিলেন, এ সমাজে নেমে আসুক সাংস্কৃতিক বিপ্লব।
আরও শুনুন: লিঙ্গসাম্যের বার্তা দিয়ে বিজ্ঞাপন তো বদলায়, সমাজের মন কি পালটায়?
২০২১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, ৭৫ বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণ নিঃসন্দেহে নিয়ে এসেছিল এক অপরিসীম শূন্যতা। তবে কমলা ভাসিনের মতো ব্যক্তিত্বরা চিরকালীন হয়ে থেকে যান তাঁদের ভাবনার বলিষ্ঠতায়। যে ভাবনা সমসময় অতিক্রম করে সময়কেই এগিয়ে দেয় সামনের দিকে, প্রগতির দিকে, আলোর দিকে। নারীর অধিকার অর্জনের আন্দোলনে যে সাহস, যে মশাল তিনি জ্বালিয়েছেন তাঁর লেখায়, বক্তৃতায় তাই-ই পাথেয় হয়ে থাকবে আগামী দিনে।