যিনি শিকড় জানেন, তিনিই শিখর স্পর্শ করতে পারেন। যিনি শূন্য চেনেন, তিনিই তাকে পূর্ণতায় বদলে দিতে পারেন। মাঝখানে থেকে যায় মাথা-উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকার স্পর্ধা। প্রতিটা বলে চোখ রেখে ইনিংসের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেওয়ার দুঃসাহস। যশস্বী তা পারলেন। পারলেন সেই পারথে দাঁড়িয়েই।
ক্রিকেটবিশ্ব যেন জানল, নক্ষত্র সন্ধানে আর দূরবিনে চোখ রাখার দরকার নেই।
সেই পারথ। সেই দ্রুতগতির পিচ। সেই দাপুটে অস্ট্রেলিয়া। আর ধসে যাওয়া গড় রক্ষা করতে এক তরুণের চোয়াল চাপা প্রতিরোধ।
১৯৯২ থেকে ২০২৪। তিন দশকের ব্যবধানে ক্রিকেটের পৃথিবীতে আমূল বদল। আইপিএল-এর মনমাতানো বিনোদনের রাংতায় টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়েই হাজার প্রশ্ন। তবু যশস্বী জয়সওয়ালের তরুণ ব্যাট যখন অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রতিরোধের নতুন কাব্য লিখেই ফেলল, তখন ক্রিকেটপ্রেমীদের স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসছে এক আঠেরোর দুঃসহ স্পর্ধা। পারথে শচীন তেন্ডুলকরের সেই ইনিংস সোনার জলে লেখা ক্রিকেটগাথায়। সাফল্যের এভারেস্ট স্পর্শ করেও সেদিনের সেই ইনিংসের কথা ভুলতে পারেননি স্বয়ং মাস্টার ব্লাস্টার। ক্রিকেটের পৃথিবী তখন সবে নতুন নক্ষত্রজন্মের সাক্ষী হচ্ছে। বিস্ময়-বালকের দ্যুতি তখন বিশ্ব-ক্রিকেটকে ক্রমে আচ্ছন্ন করতে শুরু করেছে। আর সেই শুরুর দিনে পারথের সেঞ্চুরি খোদ শচীনের কাছেই ছিল এক টুকরো হীরে। সেঞ্চুরি তো তিনি আগেও করেছেন। কিন্তু পারথ যে মহাকাব্যের ভূমি। শচীন সেদিন জানতেন, যদি পারথের উইকেটকে তিনি উইলোর জাদুতে বশে আনতে পারেন, তাহলে ক্রিকেটের দুনিয়া জয়ের আত্মবিশ্বাস তিনি পেয়ে যাবেন অনায়াসেই। খেলার ইতিহাস বলছে, নতুন অভিমুখ সেদিন খুলে গিয়েছিল। শুধু ভারতের জন্যই নয়, সামগ্রিক ভাবে ক্রিকেট-ইতিহাসের ক্ষেত্রেই তা মাইলফলক।
পারথের মাটিতেই তাই যেন নক্ষত্রজন্মের ইন্ধন। এ এমন এক রণাঙ্গন যেখান থেকে কেউ বীরের স্বীকৃতি নিয়ে উঠে আসতে পারেন। অন্যথায় ব্যর্থতার পাহাড়। যশস্বীর প্রতিভা নিয়ে কারও সংশয় ছিল না। জীবনের মার হজম করতেই করতেই উঠে এসেছেন তিনি। খ্যাতি পেয়েছেন। বিশ্বের নজরও কেড়েছেন। কিন্তু বীরের অভিধা? তা কি তাঁর ছিল! এই টেস্টের আগে পর্যন্ত তা নিশ্চিত করে বলা যেত না। তাঁর জীবনসংগ্রামের কাহিনির ভিতর সব উপাদানই তবু রাখা ছিল। একটা সময় দোকানে কাজ করতেন। মন দিয়ে কাজ না করার জন্য চাকরি খুইয়েছেন। কখনও আবার ফুচকা বিক্রি করেছেন। ধ্যান-জ্ঞান যাঁর ক্রিকেট, তাঁকে সাফল্যের সিঁড়িতে পা রাখতে অনেক পাথরই সরাতে হয়েছে। তবে, এসবই যেন জীবনের রিয়ালিটি শোয়ে দেখানো নেপথ্যগল্প। দর্শকের মন তাতে নরম হয় বটে। তবে দিনের শেষে এক এবং একমাত্র সত্যি পারফরমেন্স। যদি ঠিক সুর না-লাগে তবে গান প্রাণে বেজে ওঠে না। আর দ্রুতগতির ছুটে আসা বল যদি ব্যাটের ঠিক মাঝখান ছুঁয়ে ফিল্ডারদের চিত্রার্পিত করে বেরিয়ে না যায়, তাহলে ক্রিকেটের সৌন্দর্য খোলতাই হয় না। যশস্বী দেখালেন, তিনি সেই সৌন্দর্য রচনা করতে জানেন, যা আদতে শিল্প হয়ে ওঠে। ব্যাট হাতে তাঁর শান্ত-সংহার যেন জীবনের গল্পের সেই ক্ল্যাইম্যাক্স বিন্দু, যেখানে গল্প আর জীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। রক্তমাংসের চরিত্র তখন পেয়ে যায় নক্ষত্র হয়ে ওঠার যাবতীয় প্ররোচনা।
চলতি টেস্টের প্রথম ইনিংসে অবশ্য এই গল্পটা অন্যরকমই ছিল। শূন্য হাতে ফিরেছিলেন যশস্বী। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নও উঠেছিল। সমালোচনা বইতে শুরু করেছিল নান খাতে। যতটা প্রতিভাধর মনে করা হচ্ছিল, তিনি কি সত্যিই তা-ই! নাকি আরও একবার ক্রিকেটপ্রেমীদের বলতে হবে আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়! জীবনের অভিঘাত আগে সহ্য করেছেন বলেই বোধহয় যশস্বী জানতেন, যে, শূন্য নেহাত শূন্য নয়। চাইলে তার ভিতর ঢেউ আবিষ্কার করা সম্ভব। আসলে ক্রিকেট হোক বা জীবন, দুই-ই আসলে সমুদ্র। যা নেয়, তা ফিরিয়েও দেয়। মাঝখানে শুধু পরখ করে নেয় আসক্তি, অনুরাগ। অকীর্তিত থেকে কীর্তিমান হয়ে ওঠার পথে যেমন লড়াই-সংগ্রাম অবধারিত, তেমনই প্রতিটি ফিরে আসা চাকার গল্পে লেগে থাকে অমোঘ ভালবাসা। যশস্বী ক্রিকেট ভালোবাসেন, জীবনকেও। আর তাই যে খেলুড়ে জীবন শূন্য উপহার দেয়, তাকেই যে বশে এনে একশো করে তুলতে হয়, তা তাঁর থেকে ভালো আর কে জানেন! পথ কেউ ছাড়ে না, এমনকী জীবনও না! পথ বানিয়ে নিতে হয় জেদে-আগুনে আর আত্মবিশ্বাসে।
অতএব দ্বিতীয় ইনিংসে ফিরলেন যশস্বী। নিজেকে খুব একটা বদলালেন না। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যেতে যে তিনি তৈরি নন, তা প্রথম থেকেই বুঝিয়ে দিলেন। মাটি কামড়ে থাকা সত্যি, আবার শুধু থেকে-যাওয়া নয়। টেস্ট ক্রিকেট ধৈর্যের পরীক্ষা। বল ছাড়তে জানা সেখানে শিল্প। তবে ক্রিকেটের ব্যাকরণ যুগের সঙ্গে খানিক বদলেছে। যশস্বী তাই শুধু ছাড়ের খেলায় থাকলেন না। আক্রমণেও গেলেন। মিচেল স্টার্ককেও ছাড় দিলেন না। স্টার্কের ১৪৫-১৫০ কিমি বেগে করা বল খেলে উলটো দিকে থাকা সঙ্গীকে বলেও ফেললেন, ‘ইটস কামিং টু স্লো ম্যান’। শট খেলতে তিনি ভালোবাসেন। সেই প্রকৃতি একেবারে বদলে ফেললেন না। অথচ পরিস্থিতির সঙ্গে এমনভাবে নিজের ব্যাটিংকে মানানসই করে নিলেন যে, ক্রিকেটের নন্দনতত্ত্ব যেন নতুন অধ্যায়ের খোঁজ পেল।
স্বভাবতই সারা বিশ্ব এখন তাঁর প্রশংসার পঞ্চমুখ। ক্রিকেটের প্রাজ্ঞজনেরা তারিফ করছেন নানা ভাবে। তবে, আবার সেই গাভাসকরের কথাতেই ফেরা যাক। তরুণ নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে কিংবদন্তি বলছেন, জীবনের যে-বিন্দু থেকে যশস্বী উঠে এসেছেন, এবং যেভাবে খ্যাতির রোশনাই সত্ত্বেও নিজেকে অবিচল রেখেছেন তার তুলনা হয় না। এইটাই বোধহয় এই মহাকাব্যিক ইনিংসের মর্ম। আর সেই মর্মবিন্দুতে মিলে যাচ্ছে দশক তিনেক আগের এক সেঞ্চুরির কথা। সেদিনও পরপর কয়েকটি ইনিংসে শচীনের হাতে ছিল মাত্র গুটিকয় রান। পারথ যদি তাঁকে সেদিন পরাজিত করত, কী হত কেউ জানে না! কিন্তু জীবনের খড়কুটোকে সোনার ধানে বদলে ফেলেছিলেন শচীন নামের সেই বিস্ময়। যেমন শূন্যের আকাশকে সাফল্যের মহাকাশে বদলে দিলেন যশস্বী। নামে কি আসে যায়, আর যাঁর সম্পর্কেই বলা যাক, তাঁর সম্পর্কে কদাচ নয়।
আসলে, ক্রিকেট বদলায় মেজাজে-মর্জিতে। কিন্তু জীবনের গল্পগুলো খুব একটা বদলায় না। যিনি শিকড় জানেন, তিনিই শিখর স্পর্শ করতে পারেন। যিনি শূন্য চেনেন, তিনিই তাকে পূর্ণতায় বদলে দিতে পারেন। মাঝখানে থেকে যায় মাথা-উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকার স্পর্ধা। প্রতিটা বলে চোখ রেখে ইনিংসের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেওয়ার দুঃসাহস। যশস্বী তা পারলেন। পারলেন সেই পারথে দাঁড়িয়েই।
ক্রিকেটবিশ্ব যেন জানল, নক্ষত্র সন্ধানে আর দূরবিনে চোখ রাখার দরকার নেই।