মানুষ যদি কান পেতে পাশের মানুষের গল্পটি শোনে, দেখা যাবে সেই একই খিদে, দীর্ঘশ্বাস; একই প্রেম-কাম-দ্বিধা-দোলাচল; একই রকম কান্না কিংবা হেসে-ওঠা; মানুষের গল্পগুলো তাই আলাদা হয় না। এ কথা বুঝে গেলেই মানুষে মানুষে আর তাই কোনও বিভাজন থাকে না। গল্প তাই মানুষের ইতিহাসের আশ্চর্য অন্তর্ঘাত! মানুষের হাতে কোনও টাইম মেশিন নেই, আছে এই গল্পের আয়ুধ। গল্পের আয়নাতেই সে দেখে নেয় অতীত, মুখ দেখে সমকালেরও।
মানুষ আসলে একখানা ধারাবাহিক গল্প-ই। কবে তার শুরু, কোথায় তার শেষ কে জানে! আমরা সেই গল্পের ভিতরই বাস করি। অতএব, গল্পেরা হাঁটে-চলে, কথা বলে; শ্বাস নেয়। তবে গল্পের মৃত্যু হয় না। মানুষ স্বল্পায়ু, মানুষের গল্পেরা দীর্ঘায়ু। সেই আদিম গুহার গায়ে যিনি শিকারের ছবি লিখেছিলেন, তিনি তো বলেছিলেন মানুষের গল্পই। কে তিনি আমরা জানি না। যেমন জানি না কে প্রথম রচনা করেছিলেন রূপকথার গল্পগাছা। কোন ঠাকুমা যে প্রথম ঝুলি থেকে সে গল্প বের করে ফিরি করেছিলেন, তাও জানি না আমরা। শুধু জানি, গল্প ছাড়া মানুষ হয় না। মানুষের গল্পই মানুষের ইতিহাস।
গল্পের কাছে শৈশবের সব দস্যিপনা শান্ত হয়ে যায়। তবে শুধু শিশুমহল কেন! চিরকালের সব দস্যিপনাই গল্পের কাছে নতজানু। কেননা গল্পই তো বলে, আবহমান জীবনের উথালপাতাল গল্পগুচ্ছে ব্যক্তিমানুষ কেউ কয়েক পঙক্তি, কেউ বা অনুচ্ছেদ, কেউ কেউ বড় ভাগ্যবান বড়জোর একখানা অধ্যায়। রাজা-উজিররা সে কথা মানতে চান না। তাঁরা গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে নিজেদের গল্প রচনা করেন। তারপর ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে প্রচার করেন রাজ্য জুড়ে। সেই গল্পের চিৎকারে সাধারণ মানুষের কত না সুখ, দুঃখ, হাসি-কান্নার গল্পেরা চাপা পড়ে যায়। যদিও রাজাদের সেইসব গল্পগাছাও একদিন খেয়ে যায় সময়ের উইপোকা। স্কুলপাঠ্যের টীকাটিপ্পনী হয়ে থেকে যায় সে সব আগামীর গর্ভে। তাহলে থাকে কী! থাকে মানুষের ওই বেঁচে থাকার গল্পই। ঝড়ঝঞ্ঝায় জীবনের নৌকাখানা যে ভেসে ভেসে চলেছিল, বহু মানুষের সম্মিলিত চেষ্টায় যে নৌকাডুবি কখনোই হয় না, গল্প আসলে সেটাই। সে গল্প কেউ মুছতে পারে না। আগামীর মানুষ তাই শোনে অতীতের মানুষের গল্প। কেউ কেউ তাকেই বলে থাকেন ইতিহাস। অনেকে আবার বলেন না। না বলুন! ইতিহাস থাকুক তার সংজ্ঞা আর বিতর্ক নিয়ে। গল্পের সে সব বালাই নেই। ঝুলির মধ্যে আস্ত সভ্যতা পুরে নিয়ে সে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। গল্পের পথ কেউ আটকাতে পারে না। কেননা পথ আটকানোর গল্পটাও, নিজের শরীরের ক্ষতচিহ্ন করে তুলে রাখে গল্প। গল্প তাই সহজ-সরল, নিতান্ত ছাপোষা; আবার বেজায় রহস্যময়। তার তল পাওয়া ভার!
গল্পের অনুদান বিনা তাই মানুষ চেনাও যায় না। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব গল্প আছে। যে মানুষকে আমরা চিনি, গল্পের ভিতর থাকে সেই মানুষেরই আর এক রকমের সন্ধান। অতএব মানুষের গল্প-ই আসলে সত্যিকার মানুষ। এদিকে মানুষে মানুষে কত না বিভাজন! মত-পথ-রাজনীতি-ধর্ম-জাত ভাগের যেন শেষ নেই। এত গণ্ডি পেরিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছনো যায় কী করে? সেতু সেই গল্প-ই। মানুষ যদি কান পেতে পাশের মানুষের গল্পটি শোনে, দেখা যাবে সেই একই খিদে, দীর্ঘশ্বাস; একই প্রেম-কাম-দ্বিধা-দোলাচল; একই রকম কান্না কিংবা হেসে-ওঠা; মানুষের গল্পগুলো তাই আলাদা হয় না। এ কথা বুঝে গেলেই মানুষে মানুষে আর তাই কোনও বিভাজন থাকে না। গল্প তাই মানুষের ইতিহাসের আশ্চর্য অন্তর্ঘাত! মানুষের হাতে কোনও টাইম মেশিন নেই, আছে এই গল্পের আয়ুধ। গল্পের আয়নাতেই সে দেখে নেয় অতীত, মুখ দেখে সমকালেরও। অবশ্য গল্পেরা বহুরূপীও বটে। হাওয়া-জল বদলে গেলে পালটে যায় গল্পের গড়ন, চলন-বলন। একই গল্প মুখে মুখে ফেরে কত না বৈচিত্রে। তখন কেউ কেউ সব গল্পগুলোকে এক জায়গায় এনে জড়ো করেন। আর গল্পের চালাচালিতে জন্ম নেয় নতুন একটা গল্প। সে গল্পের ভিতরও থাকে মানুষের বেঁচে থাকার ঘ্রাণ। গল্পের তাই দল নেই, মত নেই, ভাগাভাগি নেই। গল্প কেবলমাত্র জীবনের কাছেই বিশ্বস্ত।
গল্প শোনা তাই ঠিক একটা দিনের পালনীয় কিছু নয়। তবু, একটা দিন মনে করা ভালো যে, ‘তুমি তোমার গল্প বলো, আমি আমার গল্প বলছি’। হয়তো গল্প পড়া, শোনা কিংবা শোনানো। গল্পের সঙ্গে এই সহবাস-ই মনে করিয়ে দেয়, মানুষই তার গল্প রচনা করে। আর গল্পের ভিতরই বেঁচে থাকে মানুষ।
চিরকালের মানুষের সেই গল্পটি তাই কোনোদিন ফুরোয় না, নটেগাছটিও মুড়োয় না।
আজ শুনে নিতে পারেন গল্প। সংবাদ প্রতিদিন শোনো আয়োজিত ‘গল্পের সেরা হাত’ প্রতিযোগিতার সেরা গল্পগুলো থাকল নিচে:
গল্পের সেরা হাত: উপভাষা | ধীমান বাউর