ক্ষীরভবানী মন্দিরে এসেই কালীর স্বরূপ যেন নতুন করে প্রত্যক্ষ করলেন বিবেকানন্দ। বিদেশ থেকে ফিরে শিষ্য-শিষ্যাদের নিয়ে অমরনাথ যাত্রা করেন তিনি। পথেই ক্ষীরভবানীর মন্দির। নির্জন সেই শক্তিপীঠে বেশ কিছুদিন তপস্যা করেছিলেন। এই শক্তিপীঠে মাতৃমূর্তি দর্শনের আগেই তিনি রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘Kali the Mother’, পরে যেটি বাংলায় অনুবাদ করেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।
তখনও তিনি স্বামী বিবেকানন্দ হননি। গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় দক্ষিণেশ্বরে মায়ের মূর্তির সামনে একাকী গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, পার্থিব দুঃখের কথা জানাবেন মাকে। কিন্তু সে কথা বলতে আর পারলেন কই! এক অলৌকিক অভিজ্ঞতায় সব যেন কেমন হয়ে গেল। যা চাওয়ার কথা ছিল, সব যেন ভুলে গেলেন।
তারপর জীবনের অনেকটা পথ পরিক্রমা। শিকাগো ধর্মসভায় বক্তৃতা। বিশ্ববিজয়। ধর্মপ্রচার। অনেকটা সময় পেরিয়ে নরেন্দ্রনাথ দত্ত হয়ে উঠেছেন জগদ্বিখ্যাত স্বামী বিবেকানন্দ। এই পর্যায়ে এসে আবার এক অলৌকিকের সাক্ষী হলেন তিনি, যখন গেলেন মা ক্ষীরভবানীর মন্দিরে। একান্নপীঠের অন্যতম শ্রীনগরের অদূরে দেবী ক্ষিরভবানীর মন্দির। কথিত আছে, দেবী পার্বতী এখানে ছোট মেয়ের রূপ ধরে এসে কিছু খেতে চান। তখন তাঁকে ক্ষীর দেওয়া হয়। সেই থেকে দেবী ভবানী এখানে ক্ষীর ভোগ গ্রহণ করেন। দেবীর নামকরণের মধ্যেই এ-কাহিনি নিহিত।
এই ক্ষীরভবানী মন্দিরে এসেই কালীর স্বরূপ যেন নতুন করে প্রত্যক্ষ করলেন বিবেকানন্দ। বিদেশ থেকে ফিরে শিষ্য-শিষ্যাদের নিয়ে অমরনাথ যাত্রা করেন তিনি। পথেই ক্ষীরভবানীর মন্দির। নির্জন সেই শক্তিপীঠে বেশ কিছুদিন তপস্যা করেছিলেন। এই শক্তিপীঠে মাতৃমূর্তি দর্শনের আগেই তিনি রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘Kali the Mother’, পরে যেটি বাংলায় অনুবাদ করেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। মতান্তরে, কবিতাটি তিনি ক্ষীরভবানী দর্শনের পরে লিখেছিলেন। সেই কবিতার ভাব তদানীন্তন ভারতবর্ষকে দারুণ ভাবেই প্রভাবিত করেছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে এই কবিতা এক অন্য রূপ নিয়ে ধরা দিয়েছিল। সেই কবিতায় স্বামীজির অনুভব ছিল,
‘কালী তুই প্রলয় রূপিণী, আয় মাগো, আয় মোর পাশে।
সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়,—মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহু পাশে,—
কাল-নৃত্য করে উপভোগ,—মাতৃরূপা তা’রি কাছে আসে।’
মা সেদিন সত্যিই তাঁর কাছে এসেছিলেন। এক গভীর সত্যের জগৎ যেন সেদিন উন্মোচিত হয়েছিল সন্ন্যাসীর কাছে। ইসলাম আক্রমণে বহু তীর্থক্ষেত্রই তখন ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন। সেই ক্ষতচিহ্ন ছিল ক্ষীরভবানীর মন্দির সংলগ্ন চত্বরেও। তা দেখে মাতৃসাধনায় মগ্ন সন্ন্যাসীর মন হল চঞ্চল। মনে মনে তিনি ভাবতে থাকেন, যখন মায়ের মন্দির লুট হয় তখন ভক্তেরা মায়ের কত অপমান সহ্য করেছিল। তিনি যদি তখন থাকতেন প্রাণ দিয়ে মন্দির রক্ষা করতেন। এই কথা যখন তাঁর মনে ভেসে উঠেছে, তখনই যেন শুনলেন দৈববাণী। সন্ন্যাসী শুনলেন, মা যেন বলছেন, বিধর্মীরা যদি মন্দিরের ক্ষতি করে তাতে সন্ন্যাসীর কী হয়েছে! দেবী যেন তাঁকে বলছেন ‘তুই আমাকে রক্ষা করিস না আমি তোকে?’ সেই জবাব শুনে চমক ভাঙে বিশ্ববিখ্যাত সন্ন্যাসীর। শুনতে পেলেন, মা বলছেন, চাইলে মা ভবানীই এখানে সোনার মন্দির গড়ে তুলতে পারেন।
জগতের একটি আস্তরণ যেন সেদিন তাঁর সামনে খুলে গেল। তাঁর ভাবনাচিন্তা নতুন অভিমুখ পেল। তিনি উপলব্ধি করলেন, যেখানে যন্ত্রণা, সেই বেদনার মধ্যেও স্বয়ং কালীর অধিষ্ঠান। ক্ষীরভবানী মন্দিরে মাতৃদর্শন স্বামী বিবেকানন্দকে যে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল, তা বুঝতে পারেন তাঁর শিষ্য-শিষ্যারাও। সেখানে ছিলেন নিবেদিতাও। তাঁর স্মৃতিচারণেও ধরা যাছে সন্ন্যাসীর সেই ভাবমগ্ন মূর্তি। নদীতে একছড়া মালা দেখে তিনি মনে করেন, সেটিই ছিল তাঁর নিবেদিত মালা। আশীর্বাদ হয়ে তাঁর কাছেই ফিরে আসে।
ক্ষীরভবানী মন্দিরের সেই মুহূর্ত যে স্বামীজির ধর্মচিন্তাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আর তাই তিনি জগৎবাসীকে শুনিয়ে গিয়েছিলেন, যন্ত্রণার মধ্যে দেবীর জাগরণের কথা। পরাধীন ভারতবর্ষে সেই অনুভবই সেদিন হয়ে উঠেছিল নতুন জাগরণের মন্ত্র।