বিশ্বকাপের ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মণিমুক্তো। কিছু তার মনে আছে, কিছু বা ঢাকা পড়ে গিয়েছে বিস্মৃতির কুয়াশায়। মাঠ আর মাঠের বাইরের নানা রঙের চরিত্রদের ফিরে দেখা চলতি বিশ্বকাপের মরশুমে। আচ্ছা, শুনেছেন কখনও যে, বিশ্বকাপের ট্রফি লোকানো আছে বিছানার তলায়, তাও আবার জুতোর বাক্সের ভিতরে! অবাক লাগলেও বাস্তবে কিন্তু এমনটাই হয়েছিল। আসুন শুনে নিই সেই গল্প। শোনাচ্ছেন সৌরাংশু।
ইতালি ও এসি মিলান দলের সর্বকালের অন্যতম সেরা স্টপার ব্যাক ফ্র্যাঙ্কো বারেসির নাম তো আমরা সবাই শুনেছি। যাঁরা ফুটবলের একটু বেশি খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা নিশ্চিতই তাঁর দাদা অর্থাৎ ইন্টার মিলানের জিউসিপ্পে বারেসির কথাও জানেন। তবে এখন যাঁর গল্প শোনাব, তিনি আরেক বারেসি। পুরো নাম অট্টারিও বারেসি।
আরও শুনুন: সিগন্যাল দেখেই এল ভাবনা, ফুটবলে চালু হল লাল আর হলুদ কার্ডের শাসন
এফআইজিসি অর্থাৎ ইতালীয় ফুটবল ফেডারেশনের হয়ে ১৯৩৪-এর বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে প্রথম জনসমক্ষে আসেন অট্টারিও বারেসি। হিটলার যেমন নাৎসি জার্মানির শৌর্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দেখাবার জন্য বেছে নেন ১৯৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিককে, ইতালির একনায়ক বেনিতো মুসোলিনি তেমনই বেছে নেন ১৯৩৪-এর বিশ্বকাপকে। তা সাফল্যের সঙ্গে বিশ্বকাপ আয়োজনের পর, অট্টারিও বসলেন এফআইজিসির গুরুত্বপূর্ণ পদে। এবং তার পরে ১৯৩৮-এ তিনিই হলেন ফিফার সহ-সভাপতি।
আরও শুনুন: বার দুয়েক চুরি হয়েছিল বিশ্বকাপের ট্রফি, উদ্ধারের গল্প হার মানায় সিনেমাকেও
১৯৩৮-এর প্যারিস বিশ্বকাপ হল বিশ্বকাপের ইতিহাসের অদ্ভুত ঘটনা। ইতোমধ্যেই যুদ্ধের দামামা বেজে গিয়েছে। জার্মানি দখল করে নিয়েছে অস্ট্রিয়াকে এবং অস্ট্রিয়ার সকল ফুটবলারকে একপ্রকার বাধ্য করেছে বৃহত্তর জার্মানির হয়ে খেলতে। অস্ট্রিয়ার অধিনায়ক ম্যাথিয়াস সিন্ডেলার নাৎসি জার্মানির প্রতিনিধিত্ব করতে অস্বীকার করেন। কিছুদিনের মধ্যে রহস্যজনক অবস্থায় তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায় ভিয়েনার এক হোটেলে। ম্যাথিয়াস সিন্ডলারই প্রথম বিশেষ ‘ফলস ৯’ পজিশনে খেলাকে ফুটবলে নিয়ে আসেন। তবে সে অন্য কথা।
তা সেই ১৯৩৮-এর বিশ্বকাপও জেতে ইতালি। শোনা যায়, ইতালির ফুটবল দলকে মুসোলিনি নাকি বার্তা পাঠিয়েছিলেন ‘হয় জেতো না হলে মরো’! তা হাঙ্গারির গোলকিপার হয়তো ফাইনালে চার গোল খেলে ম্যাচ হেরেছিলেন, কিন্তু পুরো ইতালি দলটাকেই প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন।
আরও শুনুন: দুই বিশ্বকাপের মাঝে থাকে ৪ বছরের বিরতি, জানেন কেন?
১৯৩৮-এর পর জুলে রিমে ট্রফিটিকে এনে রাখা হয় রোমে। এদিকে মুসোলিনির দেখাদেখি হিটলারেরও তখন ইচ্ছা হয়েছে যে বিশ্বকাপ আয়োজন করবেন। সেই নিয়ে চাপ দিতে শুরু করেন ফিফাকে। যদিও ১৯৪২-এ বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে বিশ্বকাপের কথা ফিফার আর মাথাতেই আসেনি। কিন্তু নাৎসিরা ছাড়বে কেন! তারা জুলে রিমে ট্রফি জিততে না পারুক, নিজেদের কাছে নিয়ে এসে ফুটবল বিশ্বের উপরে রাজত্ব করার ভাবনা ততক্ষণে ভেবে ফেলেছে। আর এটাই টের পেয়ে গিয়েছিলেন অট্টারিও। তিনি ব্যাঙ্কের সিন্দুক থেকে নিজের বাড়িতে ট্রফিটা নিয়ে এসে, একটা পুরনো জুতোর বাক্সে পুরে নেহাতই অযত্নে শয়নকক্ষে খাটের তলায় রেখে দেন।
আরও শুনুন: একই ম্যাচে একজন খেলোয়াড়কে তিন বার হলুদ কার্ড, নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী ছিল বিশ্বকাপ
যুদ্ধ যখন পুরোদমে চলছে আর নাৎসিরা প্রায় গোটা ইউরোপের উপর কর্তৃত্ব করছে, তখন নাৎসি গোয়েন্দা বাহিনী এটা কিছুটা আঁচ করে বার তিনেক হানা দেয় অট্টারিও বারেসির বাড়িতে। কিন্তু ওই দোমড়ানো মোচড়ানো পুরনো জুতোর বাক্সটাকে খুলে দেখার কথা আর কারোর মাথাতেই আসেনি।
১৯৪৬-এ যুদ্ধ থামলে অট্টারিও ট্রফিটি ফেরত দেন এবং পরবর্তী বিশ্বকাপের আসর ব্রাজিলে বসলে তখন জানাজানি হয় ঘটনাটা। তাহলে? শুধু মাত্র ফ্র্যাঙ্কো বা জিউসিপ্পে বারেসিই নন। ইতালির মান-সম্মান রক্ষার জন্য বিরোধী পক্ষের আক্রমণের সামনে দেওয়াল তুলে দাঁড়িয়েছিলেন অট্টারিও বারেসি-ও।