বিশ্বকাপের ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মণিমুক্তো। কিছু তার মনে আছে, কিছু বা ঢাকা পড়ে গিয়েছে বিস্মৃতির কুয়াশায়। মাঠ আর মাঠের বাইরের নানা রঙের চরিত্রদের ফিরে দেখা চলতি বিশ্বকাপের মরশুমে। ফুটবল খেলার অন্যতম দুই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র- লাল আর হলুদ কার্ড। তাদের কোথা শোনাচ্ছেন সৌরাংশু।
ফুটবল চূড়ান্ত গতিময় খেলা। আবার সেই গতির ভিতর শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আছে বেশ কিছু নিয়মকানুন-ও। আমরা সবাই মোটামুটি জানি যে, ১৮৭৭ সালেই ফুটবল খেলার একটা মোটামুটি ঠিকঠাক নিয়মকানুন তৈরি করে ফেলে ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। যা মাঠে কার্যকরী করার জন্য ১৮৮১ সালে উদ্ভব হয় ‘রেফারি’দের। তবে তার আগে কি নিয়মকানুন কিছু ছিল না? তা অবশ্য নয়। ১৮৭২ সালেই বডিকন্ট্যাক্ট স্পোর্টসে কিছুটা বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়ে এক খেলোয়াড় অপরকে ‘ফাউল’ করলে, ‘ইনডাইরেক্ট ফ্রিকিক’ দেবার চল হয়। কিন্তু এই চড়া আবেগের খেলায় দুই দলের অধিনায়কের মধ্যে সব কিছুতেই কি মতের মিল হবে? না হওয়াই স্বাভাবিক।
আরও শুনুন: বার দুয়েক চুরি হয়েছিল বিশ্বকাপের ট্রফি, উদ্ধারের গল্প হার মানায় সিনেমাকেও
তাই ১৮৭৪ সালে আসে ‘আম্পায়ার’। ফ্রিকিক হবে কি হবে না, অথবা গোল হল কি হল না, এইসব ঝুটঝামেলার ব্যাপারে মতপার্থক্য হলে আম্পায়ার গিয়ে তা মেটাতেন। আসলে এই আম্পায়ার আর রেফারির মধ্যে ফারকটা বেশ সূক্ষ্ম। দুই দলের মধ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতির বিতর্কের বিচার বা মধ্যস্থতা করেন আম্পায়ার। যেমন ক্রিকেটে, বেসবলে বা টেনিসে। ফুটবলের ক্ষেত্রে সেটা আবার বদলে যায়। এখানে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে খেলার নিয়ম কার্যকর করে দুই দলের মধ্যে সমতা বজায় রাখেন রেফারি।
আরও শুনুন: একই ম্যাচে একজন খেলোয়াড়কে তিন বার হলুদ কার্ড, নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী ছিল বিশ্বকাপ
সে যা হোক, এবারে আসা যাক কার্ডের গল্পে। হলুদ আর লাল রং ব্যবহার করে বিধিনিষেধ জারির প্রথা তো ট্রাফিক সিগনালে দেখা যায়। তাহলে কার্ড হয়ে ফুটবল মাঠে তা ঢুকে পড়ল কীভাবে? এর শুরুটা হয়েছিল ১৯৬২সালের চিলি বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে রেফারি ছিলেন একজন ইংরেজ, নাম কেন অ্যাস্টন। চিলি বনাম সুইজারল্যান্ড ম্যাচ এতটাই শক্ত হাতে তিনি পরিচালনা করেছিলেন যে, ফিফা তাঁকে সবথেকে বিতর্কিত ম্যাচেও রেফারিং-এর দায়িত্ব দেয়। সে ম্যাচ চিলি বনাম ইতালির। আশঙ্কা ছিল যে, এই ম্যাচে গোলমাল হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যেতে পারে। তা সে আশঙ্কা একেবারেই অমূলক ছিল না। অন্তত তিনটে ক্ষেত্রে মাঠে পুলিশ নামাতে হয়।
আরও শুনুন: ছিল না নাগরিকত্ব, মার্কিন দলের হয়ে গোল করে জাতীয় বীরের তকমা এই তারকার
ম্যাচ চলাকালীন ইতালীয় ডিফেন্ডার জর্জিও ফেরিনিকে তিনি মাঠ থেকে বার করে দেন। কিন্তু ভাষা অন্তরায় হওয়ায় সেই নির্দেশ বুঝতে না পেরে ফেরিনি মাঠেই দাঁড়িয়ে থাকেন। এই ব্যাপারটাই অ্যাস্টনের মাথার মধ্যে গেঁথে যায়। ১৯৬৩-তে তিনি অবসর নেওয়ার পর তাঁকে ফিফার রেফারিং কমিটির সদস্য করে দেওয়া হয়। এর পরের বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডে। সেখানে আর্জেন্টিনা বনাম ইংল্যান্ড আর একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। প্রতিদ্বন্দ্বিতার চড়া আঁচ এই ম্যাচ জুড়ে। সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক রাতিনকে ‘মার্চিং অর্ডার’ দেন রেফারি। পরের দিন সংবাদপত্রে এই ঘটনা সম্পর্কে লেখা হয় যে, রাতিনকে তো রেফারি বার করে দিয়েইছিলেন, পাশাপাশি ইংল্যান্ডের দুই ভাই- সুপারস্টার ববি চার্লটন এবং তাঁর ভাই জ্যাকিকেও সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু এই নিয়ে জনসমক্ষে এমন কিছুই ঘটেনি যে এই খবরের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হবে। খোদ ইংল্যান্ডের কোচ স্যার আলফ রামসে এই নিয়ে ফিফার কাছে সত্যতা যাচাইয়ের দরবার করেন। এই ঘটনার পরই অ্যাস্টন নিজে বিষয়টা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন।
আরও শুনুন: তরুণী সাংবাদিককে দেখে হারিয়েছিলেন মনোসংযোগ, তাঁকেই মন দিয়েছিলেন তারকা
পরের বছরেই তিনি এই সমস্যার সমাধানও পেয়ে গেলেন। তা-ও বেশ আকস্মিক ভাবেই। লন্ডনের কেনসিংটন হাই স্ট্রিট দিয়ে গাড়ি চালানোর সময় একটা ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে ছিলেন অ্যাস্টন। হঠাৎ রং ব্যবহার করে সিগন্যালে নিয়ম চেনানোর ব্যবস্থা দেখে তাঁর মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। হলুদ আলো মানে ‘সাবধানে চলো, সতর্ক হও’। আর লাল মানে ‘ব্যস, এবারে গাড়ি চালানো বন্ধ করুন’। আর পিছু ফিরে তাকাননি অ্যাস্টন। তখনই হলুদ আর লাল কার্ডের প্রস্তাব নিয়ে তিনি ফিফার কাছে যান। ফিফাও সম্মত হয়। ঠিক হয় ১৯৭০-এর মেক্সিকো বিশ্বকাপে এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হবে। যা পরবর্তী কালে, যাকে বলে একেবারে হিট হয়ে যায়।
প্রথম ম্যাচেই মেক্সিকোর বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইয়েভগেনি লভচেভ প্রথম হলুদ কার্ড দেখেন। আর প্রথম লাল কার্ড দেখেন চিলি আর পশ্চিম জার্মানির ম্যাচে চিলির কার্লোস হুমবার্তো ক্যাজেলি।
এখনও ফুটবল মাঠে জারি লাল আর হলুদ কার্ডের শাসন। অ্যাস্টন যে ব্যবস্থা শুরু করেছিলেন, বলা যায়, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।