এতগুলো বছর ধরে যে মানুষটাকে ভয় পেতে বাধ্য হয়েছি, আজ তার চোখে চোখ রাখতে পারি। বলছেন কুস্তিগির ভিনেশ ফোগত। ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে ভয় কম ছিল না। তবুও হার না মানার বার্তা দিচ্ছেন ভিনেশ ফোগত।
লড়াইটা সহজ ছিল না। জাতীয় কুস্তি ফেডারেশনের মাথা, তার উপর শাসক দল বিজেপির সাংসদ। এহেন কোনও পুরুষের নামে যৌন হেনস্তার অভিযোগ আনতে অনেকটা সাহস লাগে। অনেকগুলো দিন ধরে, একটু একটু করে সেই সাহসটা জমিয়েছিলেন ভিনেশরা। আর একবার বুকে সাহস ভরে নেওয়ার পর সোজা নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। চিৎকার করে বলেছিলেন, কীভাবে দিনের পর দিন ফেডারেশনের মধ্যেই যৌন হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে মহিলা কুস্তিগিরদের। আর সেই কুৎসিত ঘটনা ঘটাচ্ছেন কুস্তি ফেডারেশনের তৎকালীন প্রধান ব্রিজভূষণ সিং নিজেই।
আরও শুনুন:
এ কোন ‘অমৃতকাল’! সাক্ষী-ভিনেশরা মাটিতে পড়ে, মাটিতে মিশল দেশের সম্মানও
এ কথা বলতে যতটা সাহস লেগেছিল, সেই চিৎকারটা ধরে রাখতেও সাহস লাগছিল আরও বেশি। কারণ এতদিন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিটা জয়ের পর যে আলো এসে পড়ত ভিনেশদের উপরে, এই যন্ত্রণার দিনে তার ছিটেফোঁটাও পাননি তাঁরা। এতদিন যাদের হাততালিতে মুখর হতে দেখেছেন, এই সময়ে তাঁরা কেউ মুখ খোলেননি পর্যন্ত। যেদিন নতুন ভারতে সোনার ‘ন্যায়দণ্ড’ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, সেদিনও ন্যায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে ভিনেশ সাক্ষী-সঙ্গীতাদের। যৌন নিগ্রহের প্রতিকার চেয়ে সরকারের কাছ থেকে নিগ্রহ ফেরত পেয়েছেন তাঁরা। যাঁরা দেশের পতাকাকে তুলে ধরেছিলেন বিশ্বের মঞ্চে, দেশকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বের শীর্ষে, নয়া সংসদ ভবনের সামনে থেকে তাঁদেরই টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে দেওয়া হল, ধুলোয় লুটিয়ে পড়লেন দেশের সোনার মেয়েরা। ক্ষমতা আর দম্ভের নোংরা খেলায় শুধু ভিনেশরা নন, অপমানিত হলেন দেশের সমস্ত নারীরাই। ভরা বাজারে যেন পুনরায় বস্ত্রহরণ হল নারী সমাজের।
এই সমস্ত কিছু পেরিয়ে এসেছেন ভিনেশরা। তাঁদের ন্যায়বিচারের দাবি মাথা ঠুকে মরেছে আইনের এজলাসে, রাজার সভায়, জনতার দরবারে। হরিদ্বারের গঙ্গায় নিজেদের পদক বিসর্জন দিতে গিয়েছিলেন তাঁরা, এমনকি শেষমেশ খেলাই ছেড়ে দিয়েছেন সাক্ষী মালিক। আইন-আদালতের চাপে ফেডারেশন নতুন করে নির্বাচন করতে বাধ্য হলেও নয়া প্রধান হয়েছেন সঞ্জয় সিং, যিনি আবার ব্রিজভূষণেরই ঘনিষ্ঠ। চলতি লোকসভা নির্বাচনে ব্রিজভূষণ টিকিট না পেলেও ভোটে দাঁড়িয়েছেন তাঁরই ছেলে। আর এই সমস্ত কিছুই ঘটেছে গোটা দেশের চোখের সামনে। কেউ একটিও কথা বলেননি। ভিনেশরা একা লড়েছেন। হোঁচট খেয়েছেন, মুখ থুবড়ে পড়েছেন, ধুলো মেখেছেন গায়ে, ফের উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাই এতদিন বাদে, ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের খবর এসেছে যখন, সে জয়ও তাঁদের আত্মহারা করে দিচ্ছে না। বরং মনে করাচ্ছে, লড়াইটা এখনও বাকি। আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে লড়তে হবে সে লড়াই।
আরও শুনুন:
মা যা ছিলেন, যা হইয়াছেন, যা হইবেন…
কিন্তু এই এক ধাপ জয় ভিনেশদের যা দিল, তা হল আরও একটু সাহস। এতদিন তাঁরা যা যা পেরিয়ে এসেছেন, তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন, বাকি পথটাও সহজ হবে না। এতদিনকার মতোই, বারে বারে তাঁদের পথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু তাঁরা এ কথাও জানেন যে, ভয় পাওয়ার দিনগুলোকে অনেকটা পিছনে ফেলে এসেছেন তাঁরা। তাই এখন তাঁরা ভয়ের মুখোমুখি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেন। তার চোখে চোখ রেখে জানিয়ে দিতে পারেন পালটা লড়াইয়ের কথা। তাই ভিনেশ নিশ্চিত, ব্রিজভূষণ এইটুকু বার্তা পেয়ে গিয়েছেন যে, ন্যায়বিচার না মেলা পর্যন্ত মহিলা কুস্তিগিররা মাটি ছেড়ে নড়ছেন না।
এ লড়াইয়ের শেষে কী হবে, সে কথা ভিনেশরা জানেন না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও অবাঞ্ছিত স্পর্শ যে মেনে নেওয়া যায় না, সেই সহজ কথা যে সরকার বুঝতেই চায়নি, সেখানে বিচারের আশা করা যায় কি না, তাও জানেন না তাঁরা। কিন্তু ভিনেশরা জানেন, তাঁরা আর কক্ষনো ভয় পাবেন না। লড়াইয়ের বাহ্যিক ফলাফল যাই হোক, ভয়কে জয় করে ফেলার শিরোপাটা আগেভাগেই মাথায় উঠে গিয়েছে ভিনেশ-সাক্ষী-সঙ্গীতাদের।