শাসকের বিরুদ্ধে একক প্রতিবাদ গ্রাহ্য, অথচ সেই একই ব্যক্তি বিরোধী দলে যোগ দিলে পুরনো প্রতিবাদকে বাতিল করতে হবে? প্রশ্ন তুলল ভিনেশের কংগ্রেস যোগ আর ব্রিজভূষণের অভিযোগ।
শাসকের বিরুদ্ধে গলা তুলছেন কোনও নারী। প্রতিবাদ করছেন সপাটে। বসে পড়ছেন রাস্তায়। ধরনায়, মিছিলে, স্লোগানে গড়ে উঠছে আন্দোলন। আসলে তো শাসকের বিরুদ্ধে নয়, হেনস্তার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি বা তাঁরা। যৌন নির্যাতনের বিচার চেয়েছিলেন। প্রশাসনের ধারক হিসেবে শাসকের কাছেই তো সে বিচার চাওয়ার কথা। তাঁরাও সরকারের মুখাপেক্ষীই হয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে সরকারের আপাতভাবে কোনও অসদ্ভাব ছিল না। তাই তাঁদের আশা ছিল যে, সরকার তাঁদের কথা শুনবে। বিচার মিলবে নির্যাতিতার। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, বিচার চাইতেই শাসকের মুখ বদলে গেল। কেন-না, প্রতিষ্ঠানের যে প্রধান ব্যক্তিটির প্রশ্রয়ে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, শাসকের প্রশ্রয় সেই ব্যক্তির উপর থেকে সরে গেল না। তাঁকে পদ থেকে সরানো পর্যন্ত হচ্ছিল না। তাহলে বেচারা মেয়েরা আর করেন কী! প্রতিবাদে সরব হলেন। নির্যাতনের বিরুদ্ধে, নির্যাতনকে প্রশ্রয় দেওয়ার বিরুদ্ধে। শাসকের দেওয়া পুরস্কার ফেরাতে চাইলেন কেউ কেউ। তাতে শাসকের রাগ বাড়ল আরও। বাড়ল কুৎসা। তবুও প্রতিবাদের পথ ছাড়লেন না সেই এক বা একাধিক মেয়ে।
কী ভাবছেন, ঘটনাগুলো খুব চেনা চেনা লাগছে?
লাগবেই তো। এ তো আর বেশিদিনের কথা নয়। মাত্রই বছরখানেক আগের ছবি। যেখানে মাটিতে পড়ে ছিলেন সেই মেয়েরা, যাঁরা কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কাছে যৌন হেনস্তার সুবিচার চেয়েছিলেন। ভিনেশ ফোগত, সাক্ষী মালিক, সঙ্গীতা ফোগত, যাঁরা কেউ এশিয়ান গেমস কেউ বা অলিম্পিকে পদক জিতে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। অথচ তাঁরাই যখন কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিং-এর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ জানিয়েছিলেন, সেইসব কৃতিত্ব মুছে ফেলে তাঁদের প্রতিপক্ষের জায়গায় দাঁড় করিয়েছিল শাসক দল। কেননা, ব্রিজভূষণ বিজেপির তৎকালীন সাংসদ। নিজেদের দলের লোকের বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, তাঁকে ফেডারেশনের পদ থেকে সরাতেও সরকারের সে কী গড়িমসি! গত লোকসভা ভোটেও স্বমহিমায় ভোট প্রচার করেছেন সেই ব্রিজভূষণ। এত কিছুর পরে হতাশ সাক্ষী তো কুস্তিই ছেড়েছেন। ভিনেশ লড়ছেন, এখনও। সদ্য শেষ হওয়া প্যারিস অলিম্পিকে সে লড়াই আমরা দেখেছি। একদিনে পরপর লড়াই জিতে ভিনেশের ফাইনালে উঠে যাওয়া দেখে ফের পুরনো আন্দোলনের কথা মনে করেছিলাম আমরা। বলেছিলাম, এও বুঝি এক ন্যায়বিচার হল। এতদিন যাঁকে প্রায় প্রতিপক্ষ ঠাওরে নেওয়া হয়েছিল, এবার শাসকের মুখেও তাঁর নাম না উঠে উপায় নেই।
ঘটনাচক্রে অবশ্য অলিম্পিক পদক মেলেনি ভিনেশের। তবে খোদ প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা বলেছেন, সংসদে পর্যন্ত তাঁর কথা উঠেছে। তাঁর পদক না-পাওয়ার দুঃখে কষ্ট পেয়েছে গোটা দেশ। সেই আবহে কারোরই অন্য কথা বলার তেমন পথ ছিল না। কিন্তু সেই পথই খুঁজে নিলেন ব্রিজভূষণ, যেই না রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে কংগ্রেসে যোগ দিলেন ভিনেশ ফোগত। আন্দোলনে তাঁদের সঙ্গী, আরেক অলিম্পিকজয়ী কুস্তিগির বজরং পুনিয়াও তাঁর সঙ্গে নতুন পথে শামিল হয়েছেন। আর অমনি ব্রিজভূষণের দাবি, ভিনেশদের সব অভিযোগ আসলে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে করা ষড়যন্ত্র। তাঁর কথায়, “আমি কোনও মেয়ের সম্মানহানি করিনি। মেয়েদের অসম্মান করার জন্য যদি কাউকে দায়ী করতে হয়, তা হলে সেটা বজরং এবং ভিনেশকে করা উচিত।” শুধু তাই নয়, কুস্তি সংস্থার প্রাক্তন প্রধান এ কথা বলতেও ছাড়ছেন না যে, চুরি করে অলিম্পিক্সে গিয়েছিলেন ভিনেশ। যদিও এর পালটা দিয়ে বজরং বলেছেন, “ভিনেশ পদক না পাওয়ায় যারা আনন্দ পেয়েছিল, তারা দেশভক্ত?”
সরকারের আচরণের বিরুদ্ধে ভিনেশ প্রতিবাদ করায় ব্রিজভূষণরা কুকথা বলতে ছাড়েননি ঠিকই, কিন্তু তাতে ভিনেশের প্রতিবাদ স্বীকৃতি পেয়েছিল। সেসময় তাঁর মাথায় সরাসরি কোনও রাজনৈতিক ছাতা ছিল না। কিন্তু আজকে তিনি কোনও রাজনৈতিক দলে নাম লেখালে তাঁর আগের প্রতিবাদ মিথ্যে হয়ে যাবে, এমনটা তো নয়। বিজেপির বিরোধিতা সংসদীয় রাজনীতি মোতাবেক করতে হলে তাঁকে কোনও বিজেপিবিরোধী দলেই যোগ দিতে হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য। এরপরে তিনি যে যে পদক্ষেপ করবেন, সেখানে তাঁর দলীয় রাজনীতি জুড়ে থাকবে। তাঁর কথা আর কাজকে সেই রাজনৈতিক আদর্শ দিয়ে বিচার করা হবে। কিন্তু তাঁর আগের কোনও কথা বা কাজকে তো সেই একই নিক্তিতে ফেলে দেওয়া যায় না। সেই সময়টাকে দেখতে হবে সেই পুরনো সময় আর তাঁর তৎকালীন বিশ্বাসের নিরিখেই। দলীয় রাজনীতির বাইরে থাকা ব্যক্তিগত প্রতিবাদকে নেতারা তাও প্রতিবাদের গুরুত্ব দেবেন, কিন্তু দলীয় রাজনীতিতে এলে আগেকার সেই প্রতিবাদই রাতারাতি মিথ্যে হয়ে যাবে, এইভাবে কি প্রতিবাদের যোগ্যতা হারাতে পারে? ব্রিজভূষণ যাই বলুন না কেন, ভিনেশের রাজনীতিতে যোগ দেওয়া বা না-দেওয়ায় প্রাক্তন সভাপতির উপর থেকে পুরনো অভিযোগের দাগ মুছে যায় না আদৌ। একইভাবে, সেই অভিযোগের প্রতিবাদে ভিনেশের পথে নামাকেও তাঁর আজকের রাজনৈতিক অবস্থান দিয়ে নাকচ করা চলে না।