বৈভবের সেঞ্চুরির পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে একটা প্রশ্ন: ১৪ বছর বয়সে আপনি কী করছিলেন? সকলে নাহয় সে উত্তর খুঁজতে থাকুন। চোদ্দ বছর আগে বিশ্বকাপ জিতে বিশ্বক্রিকেটে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করেছিল ভারত। আর তারও এক দশক আগে, ইডেনে লড়ছিলেন দু’জন। মহামহিম অস্ট্রেলিয়ার অশ্বমেধের ঘোড়া রুখে দিচ্ছিল তাঁদের চোয়াল-চাপা জেদ। সেদিন হার-না-মানা লড়াইয়ে যে বন্ধ রাস্তা খুলেছিলেন ওঁরা দু’জন, সে-পথ ধরেই আজ সকলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বৈভব সূর্যবংশী নামে এক ‘বিস্ময়প্রতিভা’।
কে বেশি বালক! বৈভব সূর্যবংশী নাকি রাহুল দ্রাবিড়!
বয়সের হিসাব-টিসাব সরিয়ে রাখাই ভালো। বৈভবের সেঞ্চুরির পর যে দৃশ্যের জন্ম হল, একবার সেদিকে তাকানো যাক। শতরানের তৃপ্তিতে স্মিত হাসির বৈভব। সলাজ, নিষ্পাপ মুখে শান্ত ভোরের আলো। উচ্ছ্বাসপ্রবণ বিরাট-উদযাপনের যে সব ছবিছাবা ইদানীং ভারতীয় ক্রিকেটে দেখা যায়, বৈভবের আনন্দপ্রকাশের ভাষা সেই নিরিখে একেবারেই উলটো। আর উলটোদিকে শিশুর মতো আনন্দে উঠে দাঁড়িয়েছেন রাহুল দ্রাবিড়। এই ক’দিন তো তাঁকে হুইলচেয়ারে বসে থাকতেই দেখা গিয়েছে। সেই দ্রাবিড় আনন্দে প্রায় আত্মহারা। খেলোয়াড়ি জীবনে তাঁকে এমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে খুব কমই দেখা গিয়েছে। স্বভাবলাজুক, মুখচোরা প্রকৃতির তিনি বরাবরই। কোচ হয়ে দ্রাবিড় যেন অনেকখানি উচ্ছ্বাসপ্রবণ, উদযাপনময়। ব্যক্তিগত সাফল্যের তৃপ্তি একান্তে তুলে রাখাই তাঁর কাছে দস্তুর। তিনি জানেন, যত ইনিংসে সফল হয়েছেন, তাঁর থেকে ব্যর্থ হয়েছেন আরও বেশি ইনিংসে। ক্রিকেট-জীবনের এটিই শিক্ষা। আর সেই ক্রিকেট-জীবনই তাঁকে শিখিয়েছে, অন্যের সাফল্যের আনন্দ বাঁটোয়ারা হলেই বাড়ে বেশি। খুব কমজনই এই দ্বিতীয় আনন্দের স্বাদ পান। ‘গুরু’ দ্রাবিড় পান, তাঁর শিষ্যের সাফল্যে। এই সেদিন ভারত টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ জেতার পরও এমনই আনন্দে ভেসেছিলেন তিনি। সেই অপূর্ব আলো আবার ফিরল তাঁর খুদে শিষ্যের অভূতপূর্ব সাফল্যে। বৈভব আপন বৈভবে যতটা চুপচাপ, বিপ্রতীপে রাহুল ততটাই প্রকাশময়। তাহলে, কে বেশি বালক! বৈভব না রাহুল! এ-উত্তর পেতে আর বাকি থাকে না।
আসলে, সোমবার জয়পুরে একা বৈভব শতরান করেননি। করেছেন রাহুল দ্রাবিড়। এবং ভিভিএস লক্ষ্মণ। এবং মনোজ ওঝাও। বৈভব সূর্যবংশীর তিন ‘ক্ষিদ্দা’। বৈভবের সাফল্য-প্রতিভায় ভারতীয় ক্রিকেট যখন ঝলমল করছে, তখন পুরনো সে দিনের কথা ভোলা যায়! ৩৬ রানে রান-আউট হয়ে কাঁদছিল একরত্তি ছেলেটা। অনূর্ধ্ব-১৯ বিভাগের জন্য আয়োজিত বিসিসিআই-এর একটি টুর্নামেন্টে সেদিন খেলছিল বৈভব। তরুণ প্রতিভার দিকে নজর রাখার দায়িত্ব ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল’ লক্ষ্মণের। একটি বাচ্চা ছেলে আউট হয়ে কাঁদছে! দৃশ্যটি মনে ধরে তাঁর। কাছে যান। তারপর সান্ত্বনা আর সাহস দিয়ে বলেছিলেন, এখানে কে কত রান করছে সেটিই তাঁর কাছে একমাত্র বিচার্য নয়। কে লম্বা রেসের ঘোড়া তা খুঁজতেই তিনি এসেছেন। সেদিন কিংবদন্তির কথা বৈভবকে অনেকখানি সাহস জুগিয়েছিল, বলাই যায়। লক্ষ্মণ তাঁর দায়িত্ব ভোলেননি। বৈভবের কোচ জানতেন, বিহারে থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উঠে আসা বেশ কঠিন। তিনিও চাইছিলেন, তাঁর খুদে শিষ্য যেন বড় কোনও রনজি দলে খেলার সুযোগ পায়। আরও কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করে নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে সোনা করে তোলে। সুযোগটা এনে দিলেন লক্ষ্মণ-ই। ‘বন্ধু’ রাহুলকে খোঁজ দেন তরুণ প্রতিভার। নিলামে যখন নিজের দলে দ্রাবিড় নিয়েছিলেন বৈভবকে, তখন অনেকে একটু অবাকই হয়েছিলেন। মোটে চোদ্দ বছর বয়স! এই ধরনের খেলার চাপ সামলাতে পারবে তো! একখানা সেঞ্চুরি শুধু সেটুকু বুঝিয়ে দিয়ে গেল তাই-ই নয়; বুঝিয়ে দিল, জহুরির চোখ ভুল করে না।
অতএব দ্রাবিড় আনন্দিত। আইপিএল নিয়ে অনেক সময় নানা অভিযোগ উঠেছে। বিনোদনের চাপে ক্রিকেট মাধুর্য হারিয়ে ফেলছে, এমন আক্ষেপ করে থাকেন ‘বিশুদ্ধ’ ক্রিকেটপ্রেমীরা। তা হয়তো পুরোপুরি অমূলক নয়। তবে বিভিন্ন ফর্ম্যাটের আলাদা বৈশিষ্ট্য, অন্য ব্যাকরণ। তরুণ ক্রিকেটাররা তা আয়ত্ত করতে পারলে আখেরে লাভ ভারতীয় ক্রিকেটেরই। বহুদিন আগে প্রায় একই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তখন নেতৃত্ব পেয়েছেন দলের। ভারতের ক্রিকেট তখন নতুন এক বাঁকবদলের মুখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু তা সে বদল সম্ভবপর হয়ে উঠবে কী করে! শুরু হয়েছিল আঞ্চলিক স্তর থেকে প্রতিভার খোঁজ। একে একে উঠে এসেছিলেন বীরেন্দ্র সেওয়াগ, হরভজন সিং, জাহির খান, মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো প্রতিভা। বাকিটা প্রায় রূপকথা। আজ ভারত যে বিশ্ব ক্রিকেটের অবিসংবাদিত নেতৃত্বে তার নেপথ্যে এঁদের অবদান সোনার জলে বাঁধিয়ে রাখার মতো। রাহুল দ্রাবিড় তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনেই দেখেছেন এই উত্থান। পরে, অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটারদের দায়িত্ব নিয়েও তিনি তরুণ প্রতিভা লালনের কাজটিই করেছিলেন। আবার উঠে এসেছিলেন একঝাঁক ক্রিকেটার। দেখা গেল, আইপিএল-এর দায়িত্বে থেকেও রাহুল তাঁর স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি। ক্রিকেট এবং ক্রিকেট। নিজে খেলুন বা অন্যকে তৈরি করুন- ভারতের ক্রিকেটকে আর একটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও কিছুই যেন তাঁর পৃথিবীতে ছায়া ফেলে না। প্রবীণ তাম্বেকে হয়তো অনেকের মনে আছে। অন্তত তাঁকে নিয়ে তৈরি সিনেমা অনেকেই দেখেছেন। সেই প্রবীণকেও চিনেছিলেন, সুযোগ দিয়েছিলেন দ্রাবিড়ই। খেলা ছাড়ার পরও ক্রিকেটারদের যে ক্রিজ, সেখানে আজও যে তিনি অদ্বিতীয় ‘মিঃ ডিপেন্ডবল’- এ নিয়ে বোধহয় কোনও সংশয়ই নেই।
দ্রাবিড়ের এই উচ্ছ্বাস তাই ভারতীয় ক্রিকেটের আগামীর উদযাপন। তাঁর যাবতীয় ব্যথার উপর শুশ্রূষা হয়ে নেমে এসেছে তাঁর খুদে শিষ্যের সাফল্য। হুইলচেয়ার ছেড়ে তাঁর উঠে দাঁড়ানো আসলে এক অন্য আনন্দের জগতে পা রাখা। যেন সন্তানের সাফল্যে অভিভাবকের তৃপ্তি। অন্যের সাফল্য কখন নিজের হয়ে ওঠে! কেই-বা পারেন তা নিজের করে নিতে। এ কাজ সহজ নয়। সমালোচনা তুলনায় সহজ, দোষারোপ তো সহজতম। কিন্তু অন্যের দুঃখে নিজেকে ভারাক্রান্ত করা, আর অন্যের সাফল্যে শিশুর সারল্যে আনন্দিত হওয়া- আসলে শুধু ক্রিকেট নয়; এক রকম জীবনদর্শন। ‘অপর’-বিষে জর্জরিত দুনিয়া এ-ভালোবাসার দুনিয়ার চাবিকাঠি হারিয়ে ফেলে। তখন কেবলই হিংসা, ঈর্ষা, দ্বেষ। আর সেই আবিল পৃথিবীর এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকেন একজন রাহুল দ্রাবিড়। মনে মনে যেন এক অগম্যকেই গন্তব্য করে দাঁড়িয়ে থাকেন। জানেন সেই মাইলফলক ছোঁয়া কঠিন। তবু বিশ্বাস থেকে পা সরে না। একদিন সেই বহু কাঙ্ক্ষিত দিন এসে দাঁড়ায় সামনে। যখন বিশ্বাসের পৃথিবী তীব্র বাস্তব হয়ে নেমে আসে মাটির দুনিয়ায়। বাস্তবের দ্রাবিড় সেদিনই যেন হুইলচেয়ার ছেড়ে পা রাখেন অপার্থিব আনন্দের অলৌকিক জগতে। এই দুনিয়ার দরজা সকলের কাছে খোলা থাকে না। সকলে নয়, কেউ কেউ শুধু সেই পৃথিবীর ছাড়পত্র পান, যেমন রাহুল দ্রাবিড়।
বৈভবের সেঞ্চুরির পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে একটা প্রশ্ন: ১৪ বছর বয়সে আপনি কী করছিলেন? সকলে নাহয় সে উত্তর খুঁজতে থাকুন। চোদ্দ বছর আগে বিশ্বকাপ জিতে বিশ্বক্রিকেটে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করেছিল ভারত। আর তারও এক দশক আগে, ইডেনে লড়ছিলেন দু’জন। মহামহিম অস্ট্রেলিয়ার অশ্বমেধের ঘোড়া রুখে দিচ্ছিল তাঁদের চোয়াল-চাপা জেদ। যে মুহূর্ত থেকে ভারতের ক্রিকেটের যেন আবার শুরু করেছিল নতুন জার্নি। অর্জনের ষোলআনায় সাহসি পথচলা। সেদিন বৈভব সূর্যবংশী কোথাও ছিল না। তবে, সেদিন হার-না-মানা লড়াইয়ে যে বন্ধ রাস্তা খুলেছিলেন ওঁরা দু’জন, সে-পথ ধরেই আজ সকলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বৈভব সূর্যবংশী নামে এক ‘বিস্ময়প্রতিভা’।
এ কথা ঠিক যে, জয়পুরের মাঠ জুড়ে রানের ফুলঝুরি জ্বালিয়েছেন বৈভব সূর্যবংশীই। তবে, সময়ের পর্দা সরিয়ে কেউ উঁকি দিলে ঠিক দেখতে পাবেন, অন্তরালে লড়ে যাচ্ছিল সেই জুটিই- দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ। লড়ে যাচ্ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্যে। আর দিনের আলো ফুরিয়ে এলে আরও একখানা সেঞ্চুরি যেন তাঁদের পাওনা হল, যদিও তা লেখা থাকবে না কোনও স্কোরবোর্ডেই।