মাঠের দ্বৈরথ হয়তো নব্বই মিনিটে শেষ হয়, কিন্তু সমর্থকদের যুদ্ধটা চলে প্রতিনিয়ত। কেননা প্রিয় ক্লাবকে তাঁরা মিশিয়ে নেন তাঁদের যাপনে। তাই অর্থ-কীর্তি-সফলতা পেরিয়ে, সত্যি বলতে, একটা ক্লাবের চালিকাশক্তি যদি কাউকে বলতে হয়, তবে সে কৃতিত্ব একমাত্র পেতে পারেন সমর্থকরাই। সবুজ-মেরুন সমর্থকরা দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করেছিলেন ‘রিমুভ এটিকে’। সেই দাবি পূরণ হতে নতুন দিনের ভোরে নব আনন্দেই জেগে উঠেছেন তাঁরা।
তাঁরা কেঁদেছেন। রেগে উঠেছেন। ক্ষুব্ধও হয়েছে। তাঁরা হতাশায় নুয়ে পড়েছেন কখনও। কখনও হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদী। প্রিয় ক্লাবের নামের আগে অন্য কোনও নাম তাঁরা মেনে নিতে পারেননি কিছুতেই। গত তিন বছর ধরে সেই যন্ত্রণা কুরে কুরে খেয়েছে তাঁদের। কেউ সোশ্যাল মিডিয়্যা ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। কেউবা আবার রাগে-ক্ষোভে প্রাণপ্রিয় ক্লাবের খেলা দেখাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বুকের ভিতর যে সবুজ-মেরুন আবেগের জোয়ার, তা কি উপেক্ষা করতে পারেন কেউ! পারেননি বলেই দোটানা আর টানাপোড়েনের আগুন তাঁদের দগ্ধ করেছে অহরহ। সেই তাঁরাই ফিরছেন। একই উৎসাহে, আবেগে। একই ভালবাসার টানে। আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর, সঞ্জীব গোয়েঙ্কা যখন মোহনবাগানের নামের আগে আর এটিকে বসবে না বলে জানিয়ে দিলেন, তখন তাঁরাই উল্লাসে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সঞ্জীববাবুকে। তাঁরা সমর্থক। যাঁদের অফুরান আবেগ আর প্রাণশক্তিই প্রাণভোমরা হয়েই জাগিয়ে রাখে একটি ক্লাবকে। ঐতিহ্য থেকে এগিয়ে দেয় আধুনিকতার দিকে।
আরও শুনুন: ভারতসেরা মোহনবাগান, রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে সবুজ-মেরুন ঝড়ের সামনে আত্মসমর্পণ বেঙ্গালুরুর
খেলার মাঠের মূল কুশীলব কারা? এ প্রশ্নের উত্তরে একবাক্যে খেলোয়াড়দের কথাই বলবেন বহুজন। সে উত্তর যে যথার্থ, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বড় ভূমিকা অবশ্য থাকে ক্লাবকর্তাদেরও। তাঁদের ভাবনা-চিন্তা, দূরদৃষ্টি, পরিচালনার মুনশিয়ানাই এক সময় সাফল্য হয়ে ফুটে ওঠে ময়দানে। তবে এই সব পেরিয়ে আরও এক বড় ভূমিকা যাঁরা পালন করেন, তাঁরা হলেন অগণিত সমর্থক। যে টেনশন, যে আবেগ বুকে নিয়ে খেলোয়াড়রা মাঠে নামেন, সেই একই আবেগ বুকের মধ্যে পুষে রাখেন তাঁরা। মাঠের দ্বৈরথ হয়তো নব্বই মিনিটে শেষ হয়, কিন্তু সমর্থকদের যুদ্ধটা চলে প্রতিনিয়ত। কেননা প্রিয় ক্লাবকে তাঁরা মিশিয়ে নেন তাঁদের যাপনে। তাই অর্থ-কীর্তি-সফলতা পেরিয়ে, সত্যি বলতে, একটা ক্লাবের চালিকাশক্তি যদি কাউকে বলতে হয়, তবে সে কৃতিত্ব একমাত্র পেতে পারেন সমর্থকরাই। সবুজ-মেরুন সমর্থকরা দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করেছিলেন ‘রিমুভ এটিকে’। সেই দাবি পূরণ হতে নতুন দিনের ভোরে নব আনন্দেই জেগে উঠেছেন তাঁরা।
সময়ের গতিপথ যত বদলায়, তত বদলাতে থাকে চারপাশ, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি। যে মোহনবাগান বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, সেই ক্লাব যে চিরকাল একই পথে, একই রকম ভাবে চলবে, এরকম ভাবনার ভিতর আবেগ-নস্ট্যালজিয়া থাকলেও, বাস্তবতা বোধহয় ততটাও নেই। যে মার্জার নিয়ে যত বিতর্কের সূত্রপাত, তা কি সময়ের দাবি ছিল না! এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে বিস্তর। কেউ কেউ বিষয়টিকে একবারেই মেনে নিতে পারেননি। কারও মত ছিল, যদি কালচক্রে এ বাস্তবতা সঙ্গত বলে ধরে নেওয়াও যায়, তা সত্ত্বেও ক্লাবের নামের আগে অন্য কোনও নাম থাকবে, তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। একাধিকবার তাই সমর্থকরা এটিকে সরানোর দাবি জানিয়েছিলেন। এ নিয়ে বিক্ষোভও চাপা থাকেনি। তবে এখন সেসবই অতীত। গত তিন বছর ধরে যে দাবি ছিল সমর্থকদের, যে স্বপ্ন ছিল, তা পূরণ হয়েছে। আর তারপরই সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে প্রিয় ক্লাবকে নিয়ে আবেগঘন চর্চায় শামিল হয়েছেন সমর্থকরা। সমর্থকদের দাবিকে স্বীকৃতি দিয়ে সময়পযোগী পদক্ষেপের দরুন সঞ্জীব গোয়েঙ্কাকে ধন্যবাদ জানাতে দ্বিধা করেননি তাঁরা।
ক্লাবের প্রাক্তন সচিব সৃঞ্জয় বোস চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে জানিয়েছিলেন, “কর্পোরেট দরকার, আবেগকে সঙ্গে নিয়ে। আজ মোহনবাগান জিতল। এটিকে সরল। আমি সঞ্জীব আঙ্কেলকে ধন্যবাদ জানাই। ভালবাসা জানাই যারা এতদিন কটূক্তি আক্রান্ত হয়েও মাঠ ভরিয়েছে।…যারা মাঠে আসতেন না, এবার আসুন। একসঙ্গে জয় মোহনবাগান বলতে হবে যে!’ শনিবার রাত থেকে রবিবার দিনভর সোশ্যাল মিডিয়ার চর্চা জানান দিয়েছে সমর্থকরা সত্যি খুশি। মাঠ ভরিয়ে দিতে আবার একজোট হতে আর দ্বিধা নেই তাঁদের। কেননা তাঁদের একটাই পরিচয়- মোহনবাগান সমর্থক। সেই পরিচয় আঁকড়ে ধরেই আবার মাঠ মাতিয়ে দিতে তাঁরা যে মোটেও দ্বিধান্বিত নন, নেটদুনিয়ার চর্চায় ধরা পড়ল সেই ইঙ্গিতই। ভারতসেরা হওয়ার পর আবার শুরু হবে নতুন সফর। আর সেই সফরে প্রিয় ক্লাবের সঙ্গে একাত্ম হয়েই থাকবেন তাঁরা, যাঁরা জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছেন একটাই রং সবুজ-মেরুন। যাঁরা আজীবন বাঁধা পরে আছেন মোহনবাগান নামের জাদুতেই। ক্লাবও তো বুঝিয়ে দিয়েছে, সবার উপর সমর্থক সত্য! তাঁদের আবেগ-দবিকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। স্বীকৃতির এই আনন্দ ভারতসেরা হওয়ার আনন্দের থেকে কম কিছু নয়। বরং একটু বেশিই।