সুনীল মানে কেবলই দেশের সবচেয়ে ভরসাযোগ্য ফুটবলার নয়, বরং তিনি অনেক বেশি করে একজন অধিনায়ক। মাঠের ভেতর ক্যাপ্টেন্সি আর্মব্যান্ড পরিহিত ইমেজটুকুই নয় শুধু, মানুষ কবেই তাঁকে স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছেন জনগণমনের অধিনায়ক হিসেবে।
‘ভারতের সৌভাগ্য একজন সুনীল ছেত্রী আছেন, আবার ভারতের দুর্ভাগ্য যে একজনই সুনীল ছেত্রী আছেন…’। – এ কথা যিনি লিখেছিলেন, যথার্থই লিখেছিলেন। সুনীল মানে কেবলই দেশের সবচেয়ে ভরসাযোগ্য ফুটবলার নয়, বরং তিনি অনেক বেশি করে একজন অধিনায়ক। রেকর্ডের পাতা ওলটালে দেখা যাবে, তিনি দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সর্বোচ্চ গোলস্কোরার। পরিসংখ্যানের নিরিখে তিনি দেশের ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলারও বটে।
আন্তর্জাতিক ফুটবলের সর্বোচ্চ গোলস্কোরারদের তালিকা খুললে লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো নামক দুই ভিনগ্রহের মহাতারকার পাশেই থাকেন ছোটোখাটো চেহারার এক ভারতীয়। বিশ্ব র্যাঙ্কিং-এ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে প্রথম একশোতে থাকা এক দেশের অধিনায়ক। সুনীল ছেত্রীর লড়াই ছিল বিগত পাঁচ দশকে রোম্যান্টিসিজম-সর্বস্ব ভারতীয় ফুটবল, যা কিনা ১৯৭০ এশিয়ান গেমসের পর বিস্মৃত হয়ে আর কোনও দিন এশীয় ফুটবলের মানচিত্রে স্বমহিমায় ফিরে এল না, তাঁকে ফের ঘুরে দাঁড় করানো। এ লড়াইয়ের গোড়ার দিন থেকেই তিনি জানতেন তিনি অসম্ভব একা, আর সমস্ত শর্ত মেনেই তিনি সে ক্রুশকাঠ কাঁধে তুলেছেন।
সুনীল বলেন- ‘আমাকে কোচ শিখিয়েছিলেন, একজন ফুটবলার যখন হয়েছ তখন নিজের কথা ভুলে যাও, তুমি তোমার দেশের জন্য খেলো, তোমার ক্লাবের জন্য খেলো, তোমার দলের জন্য খেলো, এটাই তোমার পরিচয়…’- সুনীল বোধ করি একজন পাহাড়ি তরুণ হয়ে যতখানি আত্মস্থ করতে পেরেছেন এ সত্যকে, দেশের বহু তাবড় ক্রীড়াবিদই তা করতে অপারগ।
তবে সুনীল ছেত্রীর সবচেয়ে বড় সাফল্য কী?
তিনি স্থাণু সময়ে দাঁড়িয়ে সমাজের এক আয়না হতে পেরেছেন, যার সামনে সাদা আর কালোর প্রভেদ স্পষ্ট হয়ে যায়। দেশের হয়ে যখন পদকজয়ী কুস্তিগিররা দিল্লির রাজপথে আন্দোলন করছেন, তাঁদের দাবি এক ক্ষমতাশীল সাংসদের গ্রেপ্তারি, যিনি মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত। এ আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা, দেশের সরকারের ভূমিকা আমাদের সকলেরই জানা। তাঁর চেয়েও বেশি করে জানা দেশের তারকা-মহাতারকা ক্রিকেটারদের অদ্ভুত মৌনব্রত অবলম্বন। সুনীল ছেত্রী সেই সময়ে একটি টুইট করেন। খুব সাধারণ একটি বিবৃতি। তিনি লেখেন, ‘দেশের হয়ে পদকজয়ী কুস্তিগিরদের কেন এভাবে রাস্তা থেকে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে? এভাবে কোনও মানুষের বিরুদ্ধেই ক্ষমতাকে প্রয়োগ করা যায় না, কোনও মানুষের সঙ্গেই এমন ব্যবহার কেউ করতে পারে না। আমি চাই, এই পরিস্থিতি যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, সেভাবেই যেন নিয়ন্ত্রণ করা হয়।’ এই বিবৃতির কোথাও কোনও রাজনৈতিক দলকে সরাসরি আক্রমণ করা নেই, কোথাও শালীনতার সীমা ছাড়ানো নেই, কোথাও রাজনৈতিক পক্ষ নেওয়াও নেই, তবু দেশের আপামর জনতার চোখে এই ট্যুইটের পর সুনীল এক উঁচু আসন পেলেন।
ম্যাচের পর তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীর হাতে আর্মব্যান্ড পরিয়ে সুনীল বলেন- ‘আমি ও আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা’- প্যাট্রিয়ার্কাল সমাজে নারীদের সন্তান জন্ম দেওয়ার ওপর যে মহত্ত্ব আরোপ করা হয়, যৌথতার বোধ দিয়ে তাঁকে ভাঙলেন সুনীল।
একজন প্লেয়ারের অস্তিত্ব এই সমষ্টিবোধে। দলগত সংহতি আমাদের একের সঙ্গে একাধিক মননের সুতো জুড়ে দেয় অচিরেই। এই সংহতির বোধ সুনীলের দু’পায়ে যেমন আছে, তেমনই আছে তাঁর যাপনে- তাই তিনি এ দেশের যথার্থ অধিনায়ক। সময়ের স্রোতে যখন আমাদের সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছে, আমাদের সামনে যাঁদের খুঁটি হয়ে দাঁড়ানোর কথা ছিল তাঁরা আত্মবিস্মৃত হচ্ছেন, তখন সুনীল ছেত্রী ফ্রন্ট হয়ে যান।
এ দেশের আমজনতার মনে তাঁর মাঠের ভেতর ক্যাপ্টেন্সি আর্মব্যান্ড পরিহিত ইমেজটুকুই তাই শিরোধার্য নয়। বরং মানুষ কবেই তাঁকে স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছেন জনগণমনের অধিনায়ক হিসেবে।