সাফল্য জরুরি কথা। সাফল্য শেষ কথাও বটে। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে যেভাবে সাফল্যের ব্যাকরণ বেঁধে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা চলতেই পারে। সম্প্রতি নেহরা-প্রসঙ্গে সেই ভাবনার সুতোটিই ধরিয়ে দিয়েছিলেন সৌরভ। ক্রিকেটদুনিয়ার এই পালটে যাওয়া পরিস্থিতি আর সেই পরিস্থিতিতে পরিকল্পনার হালহকিকতকে খতিয়ে দেখলেন সরোজ দরবার।
ক্যাপ্টেন্সি যেন ময়দানের সবুজ পাতায় লেখা একখানা নতুন কবিতা। কবিতার ক্লাস বলে, সে-রচনায় ছন্দ জরুরি, মাত্রার অনুশাসন আছে; খুব আটঘাট বেঁধে না হলেও আলগোছে খানিক পরিকল্পনাও থাকে। তবে, সবার উপরে প্রবল হয়ে যা থাকে, তা হল, আকস্মিকের খেলা। একরকমের অনিশ্চয়তা, অভাবিতের সঙ্গে পাঞ্জা লড়া। সে সব আমদানি করে পরিস্থিত। কে জিতবে কে জানে! তবে সৌন্দর্য রচনার সেই লড়াইয়ে ঝাঁপ দেওয়া মাত্রই কবিতা লেখা আর ক্যাপ্টেন্সিতে কোনও প্রভেদ থাকে না।
লেখা কী করে? মূলত লেখককে নাকাল করে ছাড়ে। ভাবনা-কল্পনায় সে এই আছে তো, এই নেই। অনেক সাধ্যসাধনায় যদি বা তাকে ধরেবেঁধে সাদা পাতার উপর বসানো গেল, তখন শুরু হল আর এক সাপলুডো। লেখা নিজে এগোয় না, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, এ এক চিররহস্য। সে-রহস্যের সুলুক দিয়েছিলেন কবি জয় গোস্বামী, লিখেছিলেন, “বলছি, একটি লেখার আরম্ভসময়ে, মধ্যস্থলে, এমনকী প্রান্তে এসেও অনেক সময় লেখকের অজানা থাকে, লেখাটি কোথায় যাবে। তার গন্তব্য লেখক স্থির করা মাত্রই লেখাটি নিজের ইচ্ছেমতো আচরণ শুরু করতে পারে। লেখককে প্রায় না জানিয়েও কলমের মুখে এসে পড়তে পারে এমন সব জিনিস যা লেখক কিছুক্ষণ আগেও ভাবেনি। চরিত্ররা নিজেই নিজেদের নির্দেশ দিতে চায় লেখক-নির্দেশ না মেনে। এইমাত্র লিখে ওঠা কবিতার চারটি লাইনের দিকে তাকিয়ে লেখক ভাবতে পারে, এটা কি আমিই লিখলাম? এরা এতক্ষণ ছিল কোথায়? এমনকী এই সংশয়ও আসতে পারে তার-যা লিখলাম তার অর্থ হচ্ছে তো? লেখকের সমস্ত পূর্বধারণা নস্যাৎ করে দিতে চায় লেখাটি।”
খেলাও ঠিক এরকমই,- আকস্মিক, অভাবিত, অযুত সম্ভাবনাময়। আর সে-খেলার ভিতর যাঁরা ডুব দিয়েছেন তাঁরা প্রত্যেকেই রচয়িতা। তবু ক্যাপ্টেনের, বিশেষত ক্রিকেটে, আরও একটু বেশি ভূমিকাই থাকে। যেহেতু এই নিঃশব্দ লড়াইটায় তিনিই অগ্রগামী। সেই ক্যাপ্টেন্সি যদি ছকবাঁধা বা অন্যের দ্বারা চালিত হয়, তাহলে মূলত তা হয়ে দাঁড়ায়, চ্যাটবটে লেখা জীবনানন্দ দাশের কবিতা। সম্প্রতি অধিনায়কের দর্শনের সেই ফাঁকফোকরগুলিই চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিলেন প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। বিশেষ কিছু তিনি বলেননি। কাউকে একহাতও নেননি। শুধু জানিয়েছেন, একজন ক্যাপ্টেনকে যদি স্ট্র্যাটেজির ঝুলি বেঁধে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে মুশকিল। কেননা তাহলে পরিস্থিতি অনুযায়ী সেই অধিনায়কের চিন্তা-ভাবনা-যুক্তি-কল্পনার যে বিস্তার হওয়া উচিত, তা আক্ষরিক মাঠে মারা যায়। তাঁর এই মন্তব্য ছিল নেহরা-গিল যুগলবন্দির প্রতি। অনেকেই বলছেন, নেহরা যা করেছেন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে মেন্টরের তো সেটাই কাজ। সৌরভ এবং নেহরার মেন্টর হিসাবে সাফল্যের তুলনাও চলে এসেছে সামনে, যদিও তা নেহাতই অপ্রাসঙ্গিক। ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের মেন্টরশিপের খতিয়ান দিয়ে যদি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের অধিনায়কত্বের দর্শন মাপতে হয়, তাহলে তার থেকে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হয় না। ফলত তা নিয়ে কথা বাড়িয়েও লাভ নেই। যা বাকি থাকে, তা হল দেশের অন্যতম সেরা একজন অধিনায়কের দর্শন এবং সময়ের দাবির একটা তুলনামূলক আলোচনা। তর্ক পেরিয়ে সেখানে পৌঁছতে পারলে লাভ বই ক্ষতি নেই।
এখন, সেরা ক্যাপ্টেন কাকে বলে? হর্ষ ভোগলেকে এ-প্রশ্ন করে দেখুন, উত্তরই মিলবে না; কেননা ক্যাপ্টেন্সির আলম্ববিন্দু হল পরিস্থিতি। সেটাকে বাদ দিয়ে সেরার অভিধা দেওয়া হল আইটি সেলের প্রেক্ষিতহীন উদ্ধৃতি ব্যবহার করে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে ভোটপ্রচারের মতোই ব্যাপার। সৌরভ নিজে যে সময়ে দলের হাল ধরেছিলেন, তখন তাঁর মতো একজন আগ্রাসী, মেজাজি এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অধিনায়কেরই দরকার ছিল। দল সামলে বিদেশের মাটিতে যিনি দেশের চোয়ালচাপা জেদকে প্রতিষ্ঠা দিতে পারবেন। তা দেওয়া সম্ভবও হয়েছিল। শুধু পতাকাই নয়, উড়েছিল জার্সির নিশান। দ্রাবিড়, ধোনি বা কোহলির সময় পরিস্থিতি সেরকম ছিল না। সাফল্যের নিরিখে মহেন্দ্র সিং ধোনির ধারেকাছে কেউ আসবেন না। তবে টেস্টে হয়তো তিনি ততটা উজ্জ্বল অধিনায়ক নন। সেই সময়কার দলে কে ছিলেন আর ছিলেন না, এই তালিকার দিকেই তাকালেই এর কারণ স্পষ্ট হয়ে যাবে। আবার এসব কিছুই কি হত, যদি একদিন ক্যাপ্টেন কপিল স্নান থেকে বেরিয়েই অমন মারকাটারি একটা ইনিংস খেলার সিদ্ধান্ত না নিতেন! সেদিনের যা পরিস্থিতি, তাতে ওই ঝড়কে আহ্বান জানানো আর ছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল তাঁর! ভোগলে তাই ক্যাপ্টেন্সিতে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেন ‘কন্ডিশন’ অর্থাৎ পরিবেশ-পরিস্থিতিকে। সাফল্য তার জরুরি পরবর্তী অধ্যায়। কে কোন পরিবেশে কীভাবে সেই রাস্তা পর্যন্ত পৌঁচ্ছছেন, সেই জার্নির গল্পটুকুই আসলে অধিনায়কত্বের সারবস্তু।
ঠিক এই পরিস্থিতির কথাটাই আরও একটু রক্তমাংসের বাস্তবতা নিয়ে বর্তমান সময়ে বলতে চাইছেন সৌরভ। সময় বদলে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে এখন বারো ঘর এক উঠোন। তরুণ অধিনায়কদের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে, সে তো ভালো কথা। তবু, এ বড় সুখের সময় নেয়। কেননা সেই তরুণের মাথার পিছনে পরিকল্পনার কারুকাজ নিয়ে হাজির প্রবীণ ক্রিকেটমস্তিষ্কের চালচিত্র। তাঁদের সূক্ষ্ম শৈলী কখনও অধিনায়কের নতুন প্রতিমাকে উজ্জ্বল করে তুলছে। তবে, সেই চালচিত্র সরে গেলে যে মুশকিল হতে পারে, এমন প্রমাণও আছে হাতেগরম। ঠিক এইখানেই সৌরভ গুরুত্ব দিতে চান, মাঠের পরিস্থিতি আর অধিনায়কের যুক্তি ও কল্পনাশক্তিকে। ক্রিকেটে কি একটা বাঁধাধরা স্ট্র্যাটেজি এই প্রথম দেখা যাচ্ছে? মোটেও না। থাকে বটে একটা আদল। ‘অ’ – ‘আ’ বর্ণ কেমন দেখতে তা সকলেই জানেন, তাই বলে কি সবার হাতের লেখা এক রকম? কৃত্রিম ছাপার অক্ষর আর জ্যান্ত হাতের লেখার মধ্যে যে প্রভেদ তার কথাই তো বলছেন সৌরভ। ঠিক এই গুণেই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নিজে এগিয়ে দিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটকে। সেই পথ ধরেই উৎকর্ষের শীর্ষবিন্দুতে নিয়ে গিয়েছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। তাঁদের অধিনায়কত্বের গল্পের ভিতরই মিশে মিশে আছে অপ্রত্যাশিত সব বাঁক এবং অভাবিত উদ্ভাবন। স্থির পরিকল্পনায় এই সুযোগ নেই। ক্যাপ্টেনরা সে সুযোগের তোয়াক্কাও করেন না।
তাহলে কি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে পরিকল্পনার কৃতিত্ব পাবেন না মেন্টররা? নিশ্চয়ই পাবেন। যেখানে সাফল্যই শেষ কথা, সেখানে ‘গুরু’র গুরুত্ব খাটো করে দেখার প্রশ্নই নেই। তবে, সৌরভ বলছেন, গুরু পরামর্শ দিন। তবে, কোন দেবতা কোন ফুলে তুষ্ট হবেন তা নির্ধারণের ভার শিষ্যের হাতেই থাক। যদি তা না হয়, তাহলে একজন তরুণ অধিনায়ক পরিস্থিতির আঁচে ঝলসে যেভাবে ভিতর থেকে অগ্নিশুদ্ধ হয়ে ওঠেন, তা থাকবে না। আর তা না থাকলে ক্ষতি তো দেশেরই। আজকাল ডোমেস্টিক ক্রিকেট আর জাতীয় দলের মাঝখানে ‘সে নাছোড় ভগবান’ হয়ে আছে এই ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট। শুভমন যদি এইসব পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে নিজের নেতৃত্বের জং একটু ছাড়িয়ে নিতে পারেন, তাতে মঙ্গল তো ভারতেরই। সৌরভ বলছেন, তাঁর মতের সঙ্গে কারও ভাবনা না-ই মিলতে পারে। অধিকাংশেরই মেলেনি। তবে, চিন্তা-যুক্তির যে অনুশীলনের কথা বলছেন, তার দরুনই নেহরা আজ ‘গুরু’। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অভিজ্ঞতা। তবে, সবথেকে বড় কথা ওই কল্পনাশক্তি। পরিস্থিতি আর তার মোকাবিলা। ঠিক যেরকম একটা লেখার অভাবনীয়তার সঙ্গে মোকাবিলা চলে তার লেখকের।
সাফল্য জরুরি কথা। সাফল্য শেষ কথাও বটে। সাফল্য ছাড়া টিকে থাকা যায় না। অসফলকে কেউ মনেও রাখে না। তবে, আরও জরুরি কথা হল ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট না আমাদের সর্বস্ব, না সর্বনাশ। বরং এই পরিসরে মাঠের পাঠশালায় যদি তরুণ অধিনায়করা পাঠ নেন, মন্দ কী! ক্যাপ্টেন্সির তো আর কোনও কোটা ফ্যাক্টরি হয় না!