চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ভারত। নেপথ্যে অধিনায়ক রোহিতের ভূমিকা নেহাত কম নয়। অথচ তাঁর ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আর সেই প্রশ্ন কোনও কোচ বা ভারতীয় দলের কেউ তোলেননি, বরং সোশাল মিডিয়ায় এই নিয়ে শুরু হয়েছে চর্চা। কিন্তু একজন খেলোয়াড় খেলার জন্য আদৌ যোগ্য কি না, সেটার বিচার কি সোশাল মিডিয়া করবে?
সোশাল দুনিয়ায় একটা কথা বড় সত্যি, এখানে রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা! অবশ্য এই ‘যাহা তাহা’-র সংজ্ঞাটা ক্ষেত্রবিশেষে বদলাতেই পারে। হতেই পারে এমন জিনিস যা আমার আপনার বেশ মনোগ্রাহী মনে হল, অথচ সামগ্রিক জনতার পছন্দই হল না। কিংবা ঠিক তার উলটোটা। যদিও এক্ষেত্রে পছন্দ-অপছন্দের মাপকাঠি ভিউজ বা লাইকের সংখ্যা। তবু এই নিয়েই চলতে হচ্ছে। ভারত অধিনায়ক রোহিতকে নিয়ে সম্প্রতি যে চর্চা চলছে, সেই ঘটনাও অনেকটা এরকম। একদল মনে করছেন এই আলোচনা ভীষণ প্রাসঙ্গিক, আরেকদল ঘোর আপত্তি জানাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর ছবি তোলা থেকে বিরাট কোহলি আধ্যাত্মিক ইনিংস– নেটদুনিয়ায় সবই চর্চার বিষয়। এবং তা মাত্রাছাড়া হলেই ‘ভাইরাল’ তকমা জোটে। আক্ষরিক অর্থে নানা মুনির নানা মত, সেই সময় ভালো বোঝা যায়। তা সে আদালতে বিচারাধীন বিষয় হোক বা কারও একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যা, সোশাল মিডিয়া কিছুরই পরোয়া করে না। নিজের পছন্দের বাইরে কিছু হলেই সে ব্যাপারে পোস্ট। বাকস্বাধীনতার বলে তা করা যেতেই পারে। কিন্তু তাই বলে, সবকিছু নিয়ে কি আদৌ চর্চা করা যায়?
রোহিতের বিষয়টা এর মধ্যে ধরা যেতেই পারে। ঘটনার সূত্রপাত কংগ্রেস নেত্রী শামা মহম্মদের একটি পোস্ট ঘিরে। দিন কয়েক আগে রোহিত শর্মার শরীরী গড়ন নিয়ে মন্তব্য করেন কংগ্রেস মুখপাত্র শামা। খোলাখুলি দাবি জানান, রোহিতের ওজন কমানো উচিত। শুধু তাই নয়, তাঁকে ব্যক্তিত্বহীন অধিনায়ক বলেও কটাক্ষ করেন। ভারতীয় ক্রিকেটের অধিনায়ককে করা ‘ফ্যাট শেমিং’ নিয়ে এই কদিনে রীতিমতো ঝড় বয়ে গিয়েছে সোশাল মিডিয়ায়। বিষয়টায় অল্পদিনেই রাজনীতির রং লাগে। পালটা কঙ্গনা রানাউতের পুরনো পোস্টের প্রসঙ্গ ফেরে। এসবের মাঝে হারিয়ে যায় সেই প্রশ্ন, সোশাল মিডিয়ায় এমন কিছু বলার এক্তিয়ার কারও থাকতে পারে? হয়তো এমন পরিস্থিতি তৈরিই হত না, যদি বিষয়টাকে এতটা সহজভাবে সবাই না ভাবতেন। ক্রিকেটের প্রসঙ্গ ধরেই বলা যাক। খেয়াল রাখতে হবে, জাতীয় দলে খেলোয়াড়দের বাছাই করার নির্দিষ্ট কিছু মানুষ থাকেন। খেলোয়াড়দের ফিটনেসের দায়িত্বেও থাকেন নির্দিষ্ট কোচ। তাঁরা প্রত্যেকেই বয়সে এবং অভিজ্ঞতায় বড়। সত্যি যদি কারও ওজন বেশি হয়, কিংবা ফিটনেস নিয়ে সমস্যা থাকে, তা দেখার দায়িত্ব তাঁদের। এমন একজন খেলোয়াড় যাকে আন্তর্জাতিক মানের খেলায় অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তিনি আর যাই হন, মোটা বা আনফিট হতে পারেন না। তাহলে কি বিষয়টা নিয়ে রাজনৈতিক তরজাই লক্ষ্য ছিল? সেক্ষেত্রেও ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কের নাম জড়ানো কতটা যুক্তিযুক্ত, সেই প্রশ্ন উঠবেই!
সময়টা একটু পিছিয়ে দিয়ে, নয়ের দশকের ক্রিকেট বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ফিটনেস নয়, একজন ক্রিকেটারের প্রতিভাই ছিল বিচার্য বিষয়। সে কতটা পেটানো চেহারার অধিকারী, তা নিয়ে কোনও আলোচনাই হত না সেসময়। বরং একজন ব্যাটার অফের বাইরে থেকে হয়তো লেগ গ্লান্স করে বলটা বাউন্ডারিতে ফেলে দিল, কিংবা স্থূল চেহারার কোনও লেগ স্পিনার একহাত ঘুরিয়ে বদলে দিলেন ম্যাচের ভাগ্য। প্রতিভার পাশাপাশি এই ফিটনেস, নেহাতই গত ১৫-১৭ বছরের রেওয়াজ। তার আগেও আমরা দেখতাম, ভারী চেহারার ইনজামাম উল হক স্টেপ আউট করে সোজা ছক্কা মারলেন। সেই দৃশ্যে সাধারণ মানুষের যে নিজেকে মিলিয়ে দেখা ছিল, তা কি আজকের রোবোটিক বিরাট কোহলির খেলায় সম্ভব? সাধারণ মধ্যবিত্তের শরীর থেকে সরে গিয়েছে আজকের ক্রিকেট। সে আর ব্যতিক্রমী ক্রিকেট-শরীরকে গ্রহণ করতে পারছে না। তবু, প্রতিভার তাতে কিছু যায়-আসে না। যেমন রাজনৈতিক চর্চায় রোহিতের স্থূলতা তাঁর ক্রিকেটীয় শটে কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না কখনও।