হার তো হারই। তার কোনও কৈফিয়ত হয় না। তবু পুরো বিশ্বকাপে ভারত যে ক্রিকেট উপহার দিয়েছে তার তুলনা হয় না।
আশা ছিল। ভরসা ছিল। সম্ভাবনা তো ছিল ষোল আনাই। স্বয়ং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আশা করেছিলেন, বিশ সাল বাদ সেই বিকেলের না-পাওয়ার রঙ বদলে যাক জয়ের রংমশালে। মহেন্দ্র সিং ধোনি, বিশ্বের সেরা ক্রিকেট-মস্তিষ্ক বলেছিলেন, রোহিতের টিম এগারোর থেকেও নিখুঁত ক্রিকেট খেলছে। অতএব আমজনতার আশার পাল্লা ভারীই ছিল। মনে হয়েছিল, কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। ২০০৩-এর সেই সন্ধের বিষাদ হয়তো মুছে দিতে পারবেন রোহিত-কোহলিরা। কিন্তু হল না। ক্রিকেটীয় তুলাদণ্ডে কোথাও যেন পিছিয়ে পড়ল ভারত। চেষ্টায় খামতি ছিল না। এমনকী মহম্মদ সিরাজ যখন বাউন্ডারি মারলেন, তখন বোঝা যাচ্ছিল জয়ের জন্য কতখানি মরিয়া মেন ইন ব্লু। তবু নিয়তি বুঝি অতিক্রম করা যায় না। শামির ছোবল, বুমরাহের তীক্ষ্ণ আক্রমণও শেষরক্ষা করতে পারল না। হেড আর লাবুসেন যে বাঁশের কেল্লা গড়ে তুললেন, সেখানে তোপ দাগতে পারলেন না জাদেজা, কুলদীপ, সিরাজ। প্রত্যাশা ছিল অনেক। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছিল প্রত্যাশার চাপও। কে জানে, সেই চাপ সামলাতে না পেরেই কি শেষ মুহূর্তে ধসে পড়ল রোহিত ব্রিগেডের সাজানো লাইন আপ? গোড়ার দিকে হিটম্যান রোহিত নিজের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছিলেন বটে।
বরাবরের মতোই ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে রান রেট বাড়িয়ে দেওয়ার কাজটা শুরু করেছিলেন ভারত অধিনায়ক। কিন্তু দুই ওপেনার আউট হওয়ার পরই বোধহয় খানিক টলে যেতে হল ইন্ডিয়াকে। প্রথম ১০ ওভারের শেষ বলে বাউন্ডারি মেরেছিল ভারত। তার পর ১৬.১ ওভার লাগল পরের বাউন্ডারি মারতে। বিরাট আর রাহুল দুজনেই অর্ধশতরান তুললেও এদিন ভারতকে রানের পাহাড় খাড়া করতেই দেয়নি অজি শিবির। ২৪০ রানে ভারত ইনিংস শেষ করার পরে দলকে ধরে রাখার দায়িত্ব পুরোটাই পড়েছিল বোলারদের উপর। পরপর তিন উইকেট তুলে নিয়ে আশাও জাগিয়েছিলেন বুমরা-শামিরা। ভারত যেখানে ১০ ওভারে ৮০ রান তুলেছিল, অস্ট্রেলিয়া সেখানে তোলে ৬০ রান। কিন্তু তারপরেও শেষরক্ষা হল না। লাবুশেন-হেড জুটির দাপটে ক্রমশই ম্যাচ থেকে হারিয়ে গেলেন রোহিতরা। কুড়ি বছর পরেও, বদল এল না, বদলাও নয়। পন্টিং-এর উত্তরসূরি হয়েই ট্রফি ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন প্যাট কামিন্সরাই। হার তো হারই। তার কোনও কৈফিয়ত হয় না। তবু পুরো বিশ্বকাপে ভারত যে ক্রিকেট উপহার দিয়েছে তার তুলনা হয় না। আসলে ক্রিকেটকে আমরা যতই দেবতার আসনে বসাই না কেন, সেও তো আসলে মানুষেরই খেলা। তাই রোজ জিততে থাকা মানুষও একদিন মুখ থুবড়ে পড়তেই পারে। সেই নিয়তির সামনে অসহায় বসে থাকা ছাড়া মানুষের আর কিছুই করার থাকে না। ২০০৩ থেকে ২০২৩। ইতিহাস বদলায় না। বরং সেই পুনরাবৃত্তি। সেই অপ্রত্যাশিত হার। সেই খুলে রাখা জার্সি। তুলে রাখা কান্না। বিশ বছর পরেও একই রকম হার মেনে নেওয়া কষ্টের।
তবু কে না জানে, কষ্ট গিলে ফেলার নামই জীবন। আমরা, কয়েক কোটি ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমী আবার অপেক্ষা করব। সব দুখ আর মনখারাপ লুকিয়ে বলব, আমরা গর্বিত। এই ক্রিকেট, এই উতকর্ষের জন্য আমরা গর্বিত। আমরা জানি, হেরে গিয়েও যারা জিতে যায়, যারা মন জেতে, তারাই বাজিগর। ভারতীয় টিম, বিশ্বমঞ্চে বজায় থাকুক তোমাদের বাজিগরি। আমরা বরং বলি, চক দে ইন্ডিয়া।