চেহারা নিয়ে কটাক্ষ, অবসর নিয়ে জল্পনা, এসব উপেক্ষা করেই ব্যাট হাতে যিনি মাঠ শাসন করলেন, তাঁর নাম রোহিত শর্মা। যে যাই বলুক, অধিনায়ক হিসেবে রোহিত কতটা যোগ্য, তা আর প্রমান করতে হবে না তাঁকে। স্রেফ একটা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয় নয়, বারবার ফিরে আসার গল্প বুনে রোহিত বুঝিয়ে দিলেন, কামব্যাকের গল্পে তিনি তুলনারহিতই বটে!
শেষ যেবার ভারতের হাতে বিশ্বকাপ উঠেছিল, সেই ২০১১ সালে, দূর থেকে খেলা দেখছিলেন রোহিত শর্মা। মাঠে নেমে ব্যাট করা তো দূর অস্ত, দলেই জায়গা হয়নি তাঁর। হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু জানতেন, একদিন তাঁরও দিন আসবে। বাস্তবে তাই হয়েছে। সেদিনের দল থেকে বাদ পড়া যুবকের হাত ধরেই বিশ্বকাপের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে ভারত। তাঁর নেতৃত্বেই একের পর এক খেতাব জিতেছে টিম ইন্ডিয়া। যার সাম্প্রতিক সংযোজন চাম্পিয়ন্স ট্রফি!
:আরও শুনুন:
রোহিত শর্মার চেহারা খেলার যোগ্য কি না, ঠিক করবে সোশাল মিডিয়া?
আসলে, রোহিতের জীবন যেন কামব্যাকের গল্পে ভরা। তাঁর না আছে নায়কচিত আগ্রসন, না আছে ‘কুল’ তকমা পাওয়ার লোভ। তবু তাঁকে উপেক্ষা করে কার সাধ্যি! বরং বিতর্ক-কটাক্ষ পেরিয়ে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একথাই বলতে হয়, ‘অধিনায়ক জয় হে!’ স্রেফ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতা নয়, ফাইনাল ম্যাচে রোহিতের ইনিংস প্রমাণ করে দিয়েছে, রোহিতের আর কিছুর প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। মনে পড়ে যায় ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির কথা। ফাইনাল ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মাত্র ৯ রান করেছিলেন রোহিত। তারপর ২০১৭ সালে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শূণ্য রানে আউট হলেন। সেখান থেকে ২০২৫ সালের ফাইনাল ম্যাচে ৮৩ বলে ৭৬ রানের ইনিংস।
:আরও শুনুন:
রোহিত-বিদায়ে উল্লাসের জেরে মার, মৃত্যু ব্যক্তির… ক্রিকেট কি অসহিষ্ণু করে তুলছে ফ্যানদের?
তাঁর প্রতিভা আছে শুরু থেকেই এ কথা মেনে নিতে কারও সমস্যা ছিল না। কিন্তু প্রতিভা খেলতে আসে, আর প্রতিভা প্যাভিলিয়নে ফেরত যায়, এমন নজিরও যে ভূরি ভূরি রেখেছেন রোহিত। ধারাবাহিকতা না থাকায়, বিশ্বকাপের দল থেকে বাদ পড়েন। অনিবার্য ফল, ২০১১ সালে যখন ট্রফি হাতে নিয়ে চওড়া হাসছেন শচীন-মাহি, জয়ের মুকুট মাথায় পরছেন তাঁর সতীর্থরা, তখন সব আলোর থেকে দূরে বসে আছেন রোহিত। আফসোসে ছটফট করছেন, আর একইসঙ্গে দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিজ্ঞা করছেন, এখান থেকে এগিয়ে যেতেই হবে। মুভ অন-এর মন্ত্রটা বোধহয় সেদিনই ঝালিয়ে নিয়েছিলেন রোহিত। তিনি জানতেন, মুভ অন না করলে কামব্যাক করা যায় না। স্রেফ জানার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি রোহিত। দেশের জার্সি গায়ে, দেশের ক্যাপ্টেন হয়েছেন। একের পর এক ম্যাচে নিজের ‘হিটম্যান’ তকমার প্রতি ন্যায়বিচার করেছেন রোহিত। একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেওছেন ইতিমধ্যে, ম্যাচের গোড়াতেই সুর বেঁধে দিতে চান তিনি। সত্যিই, ব্যক্তিগত রেকর্ডকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে রোহিত যেভাবে প্রথম থেকেই দলের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দিয়েছেন, সেই সুচিন্তিত স্ট্র্যাটেজিকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই।
:আরও শুনুন:
ঠাঁই মেলেনি ২০১১’র বিশ্বকাপে, ১২ বছর পর দেশকে জয়ের দোরগোড়ায় ঠেলেই কামব্যাক রোহিতের
আসলে মুম্বইয়ের সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা রোহিত যে জানেন, কামব্যাক করতে গেলে শুধু পালটা দিলেই হয় না, সেই পালটা দিতে হয় হিসেব করেই। বাবার সামান্য চাকরির দরুন তাঁর ছোটবেলা কেটেছে ঠাকুমা-দাদুর কাছে, একলা। স্কুলের ফিজ দিতেই সমস্যা হত, সেখানে ক্রিকেট প্র্যাকটিস! তারপরেও তো লড়াইটা চালিয়ে গিয়েছেন। ক্রিকেট কিট কিনতে পারেননি, কাজ চালিয়ে নিয়েছেন অ্যাকাডেমির ফেলে দেওয়া সাজসরঞ্জাম দিয়েই। দেওধর-রঞ্জিতে দুরন্ত খেলার সুবাদে জাতীয় দল অব্দি রাস্তা খুলে গেল, তারপরেও সমালোচনার ঝড়। খেলার দুনিয়ায় যে কেবল প্রতিভা থাকলেই চলে না, তার সঙ্গে পরিকল্পনাটাও সমান প্রয়োজন, সে কথা রোহিতকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে সময়। শাস্ত্রী জমানায় রোহিত ফিরেছেন টেস্ট ক্রিকেটে। নিজেকে হিটম্যানের ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারপর তিন ফরম্যাটেই টিম ইন্ডিয়ার নেতা হয়েছেন। তাতেও কি বিতর্ক পিছু হটেছে। একেবারেই না। বরং বিরাট কোহলির হাত থেকে ক্যাপ্টেন্সির ব্যাটন হাতে আসায় নিন্দেমন্দ কম হয়নি। কোহলির সঙ্গে কর্তৃপক্ষের সংঘাত, তাঁর আকস্মিক ক্যাপ্টেন্সি থেকে সরে যাওয়া, এর সবটাই সবার চোখের সামনে ছিল। ফলে যতবার অধিনায়ক হিসেবে রোহিত ভুল করেছেন, ব্যর্থ হয়েছেন, সেই ক্ষোভ তাঁর উপরেই উগরে দিয়েছেন বিরাট-ভক্তরা। তার উপর দিনের পর দিন রান না পাওয়ার চাপ। কে জানে, ‘হিটম্যান’ তকমাটা সেসময় রোহিতের দিকে তাকিয়ে মুখবিকৃতি করত কি না!
সেখান থেকে আজকের রোহিত শর্মা। ভারতের যোগ্য অধিনায়ক। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের নায়ক। আরও কত কী! সবকিছু ঝুলিতে ভরে মাঠ ছাড়লেন। আর যেতে যেতে প্রমাণ করে দিলেন, কামব্যাকের গল্পে তিনি তুলনারহিতই বটে!