রাহুল দ্রাবিড়কে গুরুদক্ষিণা দিলেন। দেশকে আরও একবার বিশ্বজয়ের স্বাদ অনুভব করালেন। শেষবেলায় রাজার সাজে বিদায় নিলেন রোহিত শর্মা। টি২০ থেকে অবসর ঘোষণায় ভারত অধিনায়ককে খোলা চিঠি লিখলেন কৃশানু মজুমদার।
শ্রদ্ধাভাজনেষু শ্রীযুক্ত রোহিত শর্মা,
স্বপ্ন ছুঁয়ে আপনি ভরা সাংবাদিক বৈঠকে বললেন, ”এটা আমারও শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ ছিল।” মিডিয়া রুমে করতালির ঝড় উঠেছে তখন। কোথায় যেন অনুরণিত হচ্ছে, ”বইছে বাতাস যাবে আর কতদূরে…তোমার অভাবে এ হৃদয় উপবাসে, গন্ধে দ্বিগুণ তোমাকেই ভালোবাসে।”
এ কি শুধু আমার হৃদয়ের কথা! ভুল বললাম, গোটা দেশের রিংটোন তো এটাই, ”তোমার অভাবে এ হৃদয় উপবাসে, গন্ধে দ্বিগুণ তোমাকেই ভালোবাসে।”
রোহিত গুরুনাথ শর্মা, আপনি রাহুল দ্রাবিড়কে গুরুদক্ষিণা দিলেন। মিস্টার ডিপেনডেবলের সেই অমর মন্তব্য আরও একবার শুধু আপনার জন্যই বলতে ইচ্ছা করছে, ”কখনও আশা ছাড়তে নেই। আপনি যেটা ভালো পারেন সেটা মনপ্রাণ দিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে করুন। দেখবেন কোথাও ন্যায়বিচার অপেক্ষা করে রয়েছে।”
ন্যায়বিচার পেলেন রাহুল দ্রাবিড়। ন্যায়বিচার পেলেন আপনিও।
রোহিত শর্মা, আপনার সুখে গোটা দেশ সুখী। আপনার সঙ্গে হাসছি আমি। আমার মতো কোটি কোটি ভারতবাসী। মনে পড়ে যাচ্ছে নভেম্বরের সেই দুখজাগানিয়া রাত। সেই দুঃসহ স্মৃতি আপনি মনে রাখতে চান না। দিনকয়েক আগে বিশ্বকাপ চলার সময়ে আহমেদাবাদ এবং নভেম্বরের সেই ঘটনাবহুল রাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক প্রমোশনাল ভিডিওয়। রোহিত শর্মা পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “গোটাটাই কী দুঃস্বপ্ন ছিল?”
তারপর কেটে গিয়েছে সাত-সাতটা মাস। গঙ্গা-যমুনা দিয়ে কত জল গড়িয়ে গিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। রোহিত গুরুনাথ শর্মা, সেই স্মৃতি আপনাকে ধাওয়া করে বেরিয়েছে। আহত ক্ষতে বুঝি প্রলেপ পড়ল শেষমেশ। তেরো বছর পরে ভারতকে বিশ্বজয়ী করলেন আপনি। একদিন যেভূমিতে ভারতের ক্রিকেটের সূর্যাস্ত হয়েছিল, সেই ক্যারিবিয়ান ভূমেই সূর্যোদয় ঘটল। আবেগপ্রবণ আপনাকে দু’ চোখ ভরে দেখছিলাম। আপনি কখনও কোহলির সঙ্গে তেরঙা উঁচিয়ে ধরলেন। কখনও আবার জাতীয় পতাকা পুঁতে দিলেন বার্বাডোজের মাঠে। নোভাক জকোভিচের মতো পিচের ধুলো চেখে দেখলেন, ‘ধুলায় ধুলায়, ঘাসে ঘাসে’ আপনি নিজেকে মেলে দিলেন। হার্দিকের গালে চুমু এঁকে দিলেন। কখনও আপনি কাঁদলেন। কখনও হাসলেন। আপনার সঙ্গে সঙ্গে কান্না-হাসির দোলায় দুললাম আমরাও। সুখের স্মৃতি, সব পেয়েছির আনন্দ শরীরে মেখে ভরা সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়ে দিলেন, ”এটাই বিদায় জানানোর সেরা সময়।”
রোহিত শর্মা, আপনি কি ভারতীয় ক্রিকেটের কর্ণ? হয়তো তাই। হয়তো নয়। আপনার প্রতিভা প্রশ্নাতীত। অথচ বীরপুজো তো আপনাকে নিয়ে হয় না! আপনি রেকর্ড গড়বেন, রেকর্ড ভাঙবেন, ম্যাচ জিতবেন, ম্যাচ জেতাবেন, সেঞ্চুরি করবেন, ছক্কা মারবেন, ফর্ম দেখাবেন…কিন্তু ব্যাট-প্যাডের ফাঁক দিয়ে বল গলে গেলেই গোটা ভারতবর্ষ চিৎকার করে বলবে, ”রোহিত শর্মা, আপনার থেকে যে আরও অনেককিছু আশা করেছিলাম।”
ক্যারিবিয়ান ভূমে কি আপনি অনুচ্চারে বলে গেলেন, ”দেশের ক্রিকেট আমার হাতে সুরক্ষিত।” অথচ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ, পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ বিপর্যয়ের পরে আপনি রক্তাক্ত হয়েছেন, নিন্দুকরা নখ-দাঁত বের করেছেন, আপনি কিছু বলেননি। আপনার নীরবতা অনেক কিছু বলে গিয়েছিল। মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। অবশেষে ভারতের ক্রিকেট যখন নতুন এক সকাল এল, আপনি বলে দিলেন, ”এই কাপ জিততে চেয়েছিলাম আমি।”
জানেন রোহিত শর্মা, আব্বাসউদ্দিন যেভাবে গাইতেন, ”আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দেরে তুই আল্লাহ মেঘ দে…।” ঠিক সেই ভাবেই আমাদের আর্তি ছিল, বিশ্বকাপেও আপনি ছায়া দিয়ে যাবেন। আপনি বনস্পতি। আপনি ফল দেবেন, ভারতীয় ক্রিকেট ফুলে-ফলে শাখাপ্রশাখা মেলে দেবে আপনার ছত্রছায়ায়। বলতে দ্বিধা নেই রোহিত শর্মা, শনিরাতে আপনিই তো হয়ে উঠেছিলেন মিস্টার ইন্ডিয়া। দেশের শ্বাসপ্রশ্বাসে শুধুই আপনি। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীকে এককাট্টা করে রেখেছিলেন আপনিই ক্যাপ্টেন।
কে যেন বলে উঠেছিল, একটা দুরন্ত ছয় মারল ছেলেটা।
জ্যোৎস্না পার হয়ে বলটা গিয়ে পড়ল আসামের জঙ্গলে,
সেখানে তিনজন টেররিস্ট বসে আছে সাইনাইড খাবে বলে
তিনজনই লাফিয়ে উঠল, আঃ মৃত্যু! দাঁড়াও! আর একটা ছয় দেখে যেতে চাই।
জ্যোৎস্না পার হয়ে, বল এসে পড়ল এবার বম্বের ধারাভিতে।
তিনজন মারামারি করছিল রুটি তরকা নিয়ে, থেমে গেল।
জোয়ারের মত বেরিয়ে গেল গোটা ঝোপড়ি
খেতে-না-পাওয়া জ্যোৎস্নায় থমকে দাঁড়ানো ভারতবর্ষ।
দক্ষিণ আফ্রিকা তখন ভারতের রান তাড়া করছে। পেন্ডুলামের মতো দুলছে ফাইনাল ম্যাচ। কপিলদেবের ছিলেন মহিন্দর অমরনাথ, মহেন্দ্র সিং ধোনির যোগিন্দর শর্মা, আপনার হাতের তুরুপের তাস হার্দিক পাণ্ডিয়া। আপনার ছোঁয়ায় ভারতের ক্রিকেটে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার আলো ভেসে যাচ্ছে।
কেরিয়ারের একদম শুরুর দিকে আপনিও বিশ্বজয়ের স্বাদ পেয়েছিলেন। ২০০৭-এর বিশ্বজয়ী দলের সদস্য ছিলেন আপনি। সেই বিশ্বকাপ ছিল যুবরাজ সিংয়ের, সেই বিশ্বকাপ ছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির। প্রতিশ্রুতি জাগানো রোহিত শর্মা হঠাৎ করেই সেই বিশ্বজয়ের পর আড়ালে চলে গিয়েছিলেন। চড়াই উতরাই অতিক্রম করে আপনি আলো ছড়িয়ে দিলেন আইপিএলের গ্রহে। গত একদশকে পাঁচ-পাঁচবার মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে চ্যাম্পিয়ন করলেন। শাস্ত্রী জমানায় ফিরলেন টেস্ট ক্রিকেটে। নিজেকে হিটম্যানের ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করলেন। তারপর তিন ফরম্যাটেই টিম ইন্ডিয়ার নেতা হলেন। আহমেদাবাদের অন্ধকার রাতের সেই বৃত্ত যেন পরিপূর্ণতা পেল বার্বাডোজের কেনসিংটন ওভালে। ক্রিকেট যে জীবন নয়, এরপরেও কেউ অমত হবেন?
এবার থেকে রোহিত শর্মা আপনার উদাহরণ দেখিয়ে ঝুঁকে থাকা, নুইয়ে পড়া জীবনকে বলব, ”কখনও আশা হারাতে নেই। কোথাও ন্যায়বিচার অপেক্ষা করে রয়েছে।”
ইতি আপনার
একান্ত গুণমুগ্ধ ভক্ত