বিসিসিআইয়ের তরফে ৫ কোটি টাকার পুরস্কারমূল্য পাওয়ার কথা ছিল হেড কোচ দ্রাবিড়ের। তিনি অস্বীকার করেছেন। যুক্তি এই যে, কোনওভাবেই তিনি ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং কোচদের থেকে বেশি টাকা পেতে পারেন না। তাই ফিরিয়ে দিয়েছেন ২.৫ কোটি টাকা। হেলায়। ঠিক যেমনভাবে দ্রুতগতিতে ছুটে আসা বল পা বাড়িয়ে ছেড়ে দিতেন তিনি। আর বুঝিয়ে দিতেন, ডিফেন্সের নামই কখনও আক্রমণ হয়ে যায়। লিখছেন সম্বিত বসু।
ব্যাট সবসময় শাসন করে না বলকে। বলে না, মাটি ওপর দিয়ে দ্রুত দৌড়ও কিংবা উড়ে যাও বাউন্ডারির বাইরে। পা এগিয়ে বল ছেড়ে দেওয়াটাও ক্রিকেটের অংশ। এসব তখন ঘোরতর সত্য ছিল যখন ক্রিজে থাকতেন রাহুল দ্রাবিড়। যখন বহুদূর থেকে রান আপ নিয়ে বল করতে আসতেন শোয়েব আখতার, অবাক হয়ে দেখতেন, তাঁর ১৫০ কিমি গতিসম্পন্ন বল শান্ত হয়ে পিচেই ঘুমিয়ে পড়ল ব্যাটের ছোঁয়ায়। লাল বলের ঘুমের ওষুধ ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। কিন্তু একে কী বলা উচিত ক্রিকেটীয় পরিভাষায়? ডিফেন্স? অথচ দ্রাবিড় বলেছিলেন, ‘পেস বোলারকে সামনের পা বাড়িয়ে ঠুকে দেওয়ার মানে আক্রমণ।’ তাহলে আমরা যাকে ‘ডিফেন্স’ বলি, তাও আসলে রূপ বদলে ‘আক্রমণ’ হয়ে যেতে পারে? এভাবে তো ভাবাতে পারেন কোনও দার্শনিক! সে কি কেবলই এক প্রতিভাবান ক্রিকেট-খেলিয়ে? কেবলই জাতীয় দলের জার্সি পরতে পারা ব্যাটার-উইকেটকিপার-অধিনায়ক?
আরও শুনুন:
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়: ক্রিকেট-রূপকথায় যে চরিত্র বারবার আসে না
স্থিতধী, অচঞ্চল, পার্টনারশিপ-প্রিয় এই ‘ভদ্রলোক’ কী পেয়েছিলেন প্রথম জীবনে? তীক্ষ্ণ খোঁটা– ছেলেটা বড্ড টুকুর টুকুর করে! রাহুল কীভাবে নিয়েছিলেন এই সমালোচনা? এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আসলে আমি মারতাম জোরে, বল ফিল্ডারের কাছে দ্রুত পৌঁছত। ফলে খুচরো রান হত না। এই সমালোচনা পেয়েছিলেন বলেই তিনি আস্তে শট খেলতে শুরু করেন। ছোট ছোট করে এক রান, দু’রান নিতে শুরু করেন। সমালোচনাকে কীভাবে গ্রহণ করতে হয়, তা দেখিয়েছিলেন রাহুল, তাঁর কেরিয়ারের শুরুতেই। লক্ষ্মণ যখন ২৮১ করলেন ইডেনে, রাহুল করেছিলেন ১৮০। টনটনে সৌরভ গাঙ্গুলি যখন ১৮৩, রাহুল তখন ১৪৫। ’৯৯-এর নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে শচীন যখন ১৮৬ নট আউট, তখন রাহুল ১৫৩। পরিসংখ্যান বলে, বড় ইনিংসের নেপথ্যে একটা ‘শরদ’কাল ছিলই। সাক্ষাৎকারে এ প্রশ্নও করা হয়েছে বহুবার, তিনি এত ভালো খেলেও, প্রতিবার পার্টনারশিপ করেও, ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন না, এতে খারাপ লাগে না? রাহুল বলেছিলেন, কেউ যদি ভারতের জন্য একটা ম্যাচও খেলতে পারে, তাহলেও তাঁর গর্ব করার কথা। আর তিনি তো দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর দেশের হয়ে খেলেছেন! এই সময়, যখন দেশে প্রতিদিন নানা প্রকারে বেড়ে চলেছে অসহিষ্ণুতা, স্বার্থই হয়ে উঠেছে মানুষের শেষ ও একমাত্র সরাইখানা, তখন দ্রাবিড়ের জীবনকে জানা একরকম নিঃস্বার্থ হওয়ার কোর্সওয়ার্ক।
এত কিছু পরও কখনও কোনও বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য হতে পারেননি দ্রাবিড়। অধিনায়ক হিসেবে অসফল হয়েছেন। তাঁর শেষতম বড় চোখে-পড়া কাজ এই ভারতীয় পুরুষ দলের হেড কোচ হওয়া। এই একবার, মাত্র একবারই দ্রাবিড় নিজের খোলস ছেড়ে বেরিয়েছেন। বিশ্বকাপ ধরে উন্মত্ত হয়ে খানিক ঝাঁকিয়েছেন, জড়িয়ে ধরেছেন রোহিত-বিরাটদের। মুম্বইয়ের জয়ের বিজয়োৎসবেও সেই আনন্দের রেশ খানিক থেকে গিয়েছে দ্রাবিড়ের আচার-ব্যবহারে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যে মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়, তার বহু নাম থাকতে পারে, কিন্তু সে দেওয়ালের নাম নিশ্চিতভাবে রাহুল দ্রাবিড়।
তবু বিশ্বকাপ জিতে দ্রাবিড় বদলে যাননি মোটেই। কেন বলছি এ কথা? বিসিসিআইয়ের তরফে ৫ কোটি টাকার পুরস্কারমূল্য পাওয়ার কথা ছিল হেড কোচ দ্রাবিড়ের। তিনি অস্বীকার করেছেন। যুক্তি এই যে, কোনওভাবেই তিনি ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং কোচদের থেকে বেশি টাকা পেতে পারেন না। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী টিমের কোচ হিসেবেও দ্রাবিড় সমবণ্টন চেয়েছিলেন এর আগে। বাকিরা পেয়েছিলেন ২০ লাখ, ৫০ লাখ পাওয়ার কথা থাকলেও, দ্রাবিড়ও ২০ লাখই নিয়েছিলেন।
আরও শুনুন:
ষোলোর সোলো শোয়ে নক্ষত্রের জন্ম, ইয়ামালের রূপকথা যেন মতি নন্দীর উপন্যাস
দ্রাবিড় যে পাঁচিল– এ কথা ক্রিকেট বিশ্বে প্রমাণিত। কিন্তু তিনি পাঁচিল ভেঙেওছেন। অসাম্যের। শুধু এই দু-একটা ক্ষেত্রে নয়। দ্রাবিড় ভোট দিতে গিয়ে লাইন দিয়েছেন বাকি মানুষদের মতোই। ছেলে সমিত দ্রাবিড়ের খেলা দেখতে গিয়ে বসেছেন সকলের মতো সিঁড়িতেই। ছেলেকে ক্রিকেট কোচিংয়ে নিয়ে গিয়েছেন অটো চড়ে। শুধুমাত্র বিশ্বকাপের পুরস্কারমূল্যের সমবণ্টনে তাই দ্রাবিড়কে চেনা যাবে না। এ তাঁর জীবনবহির্ভূত একটা বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। এ তো আমাদেরই চিরচেনা দ্রাবিড়। আরও একবার পা বাড়িয়ে ছেড়ে দেওয়া অসাম্যের বলটিকে। আরও একবার লোভের বলটিকে নিজের পায়ের কাছে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া।
ইতিহাস বলে দ্রাবিড় এককালে সভ্যতা ছিল, কেউ কেউ জানি, দ্রাবিড় সভ্যতা এখনও আছে। আলবাত আছে।