যে দেশে প্রেম ভাঙলে প্রেমিকার মুখ অ্যাসিডে পুড়ে যায়, সেখানে বিচ্ছেদের পরও জনতার আক্রমণ থেকে প্রেমিকাকে বাঁচাতে ঢাল হয়ে দাঁড়ান বিরাট। তথাকথিত ‘মর্দাঙ্গি’-র শর্ত ঝেড়ে ফেলেই অনায়াসে স্বীকার করে ফেলেন, অনুষ্কার থেকে লড়তে শিখেছেন তিনি। কেবল লড়াই নয়, ভালোবাসা আর সম্মানের মন্ত্রটাও বোধহয় তাঁর অনুরাগীদের সামনে রেখে দিয়েছেন বিরাট।
বিরাট কোহলি মানে শুধু ক্রিকেট নয়। আর শুধু ক্রিকেট দিয়ে বিরাট কোহলিকে বোঝা যাবে না।
২০০৮ সালে ভারতের জার্সিতে তাঁর অভিষেক। তাঁর সমসাময়িকরা এসেছেন। আবার চলেও গিয়েছেন। নিজেও খারাপ সময় কম দেখেননি বিরাট। ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২-এর প্রথম ৮ মাস কোনও শতরান পাননি তিনি। তিন-তিনটে বছর। নিখুঁত যন্ত্রের মতো রান করে যাওয়া কিং কোহলি-র ব্যাট জাদু হারিয়েছে। পাশ থেকে সরে যাচ্ছে জনতার ভিড়। টের পাচ্ছিলেন বিরাট। এরই মধ্যে হাত থেকে প্রায় কেড়ে নেওয়া হল টেস্ট অধিনায়কের রাজদণ্ড। এককালে যাঁর অসম্ভব ফ্যান ছিলেন, সেই সৌরভের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্কের কথা অজানা রইল না কারোরই। এই পরিস্থিতিতে কামব্যাক করা তো পরের কথা, ফিরে আসার তাগিদটাই আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় অনেকের। কিন্তু তিনি তো বিরাট। ভিড়ের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো তাঁর বরাবরের স্বভাব। তাই বিরাট ফিরলেন, রাজার মতোই। সমালোচকদের মুখ বন্ধ করিয়ে দিলেন সপাট কভার ড্রাইভে। দু-দুটো বিশ্বকাপের নকআউটের মোক্ষম সময়ে যিনি উইকেট ছুড়ে দিয়ে এসেছিলেন, চলতি বিশ্বকাপে রান তুলেই তিনি ছাপিয়ে গেলেন খোদ শচীন তেন্ডুলকরের রেকর্ড। আইসিসি টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ রানের মালিক এখন তিনিই। আসলে বিরাট একটা কথা জানেন। তাঁর নিখুঁত খেলার ধরন, শিল্পের উৎকর্ষে পৌঁছে যাওয়া- এ সবকিছু নিয়ে ক্রিকেটীয় বোদ্ধারা আলাপ আলোচনা চালাতে পারেন। কিন্তু জনতা স্রেফ রেকর্ড মনে রাখে। খেয়াল রাখে ট্রফির হিসেব। তাই বিরাট নিজেকে বারবার মনে করিয়েছেন, দলকে জেতাতেই হবে। বাংলাদেশের তারকা ক্রিকেটার তামিম ইকবালের সঙ্গে এক একান্ত আলাপে বিরাট বলেছিলেন, যখন কেউ ভরসা করছে না, সবাই না-এর দলে; সেই সময় নিজেকে একা হ্যাঁ-এর পক্ষে দাঁড়াতে হয়। আর তাহলেই খেলা ঘোরে, বিশ্বাস করেন বিরাট। তাই নিজের সঙ্গে সঙ্গে গোটা ভারতবর্ষকে সেই বিশ্বাসে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। ভাবতে শিখিয়েছেন, স্কোরবোর্ডকে নিজের দলে না এনে মাঠ ছাড়তে নেই।
আরও শুনুন: শুধু ধর্ম ধর্ম! তোমার ক্রিকেট নেই, ভারতবর্ষ!
আর এখানেই বোধহয় বিরাট কখন ‘আমরা’ হয়ে গিয়েছেন। হ্যাঁ, তিনি বিপণন দুনিয়ার পোস্টারবয়, তিনি ফোর্বস ইন্ডিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকা, তিনি বলিউডি নায়িকার সঙ্গে প্রেমের রূপকথা লেখেন, তিনি আলিবাগের জমিদারি-সদৃশ ফার্মহাউসের মালিক- সেই তিনি আমাদের গড়পড়তা যাপনের থেকে অনেক উপরে। কিন্তু তিনি নিখুঁত নন। যে ক্রিকেট দুনিয়া স্লেজিংকে গায়ে না মাখতে শিখিয়েছে, সেখানে তিনি আলটপকা স্লেজিং-এর পালটা চেঁচিয়ে ওঠেন। আগ্রাসী মারে তিনি না-পাওয়াদের গুঁড়িয়ে দিতে চান। এমন অনেক কথা বলে বসেন, যা ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’-এর ধার ধারে না। এইসব খুঁতগুলোতেই হয়তো আমরা নিজেদের মুখ দেখতে পাই। আর সেই মিলগুলোই কোহলিকে ভালোবেসে ফেলে। বাধার সামনে মাঠ ছাড়তে চাইলে মনে করিয়ে দেয় সেই বছর আঠেরোর তরুণকে, বাবার মৃত্যুর পরের দিনেও যে দলকে জেতাতে মাঠে নেমেছিল।
আরও শুনুন: ‘ভাবী’ সারাকে নিয়ে উত্তাল গ্যালারি! অনুষ্কার মতোই কি ভবিতব্য শচীন-কন্যার?
আবার এই বিরাটই তো আদ্যন্ত প্রেমিক। যে দেশে প্রেম ভাঙলে প্রেমিকার মুখ অ্যাসিডে পুড়ে যায়, সেখানে বিচ্ছেদের পরও জনতার আক্রমণ থেকে প্রেমিকাকে বাঁচাতে ঢাল হয়ে দাঁড়ান বিরাট। যতবার তাঁর রান না পাওয়ার জন্য অনুষ্কার দিকে আঙুল উঠেছে, তিনি রুখে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে বেফাঁস কথা বলার দায়ে সাংবাদিককে একহাত নিয়েছেন, নিজের ইমেজ না বাঁচিয়েই। আবার তথাকথিত ‘মর্দাঙ্গি’-র শর্ত ঝেড়ে ফেলেই অনায়াসে স্বীকার করে নিয়েছেন, অনুষ্কার থেকে লড়তে শিখেছেন তিনি। কেবল লড়াই নয়, ভালোবাসা আর সম্মানের মন্ত্রটাও বোধহয় তাঁর অনুরাগীদের সামনে রেখে দিয়েছেন বিরাট।
তাই বিরাট কোহলি মানে শুধু ক্রিকেট নয়। আর শুধু ক্রিকেট দিয়ে সত্যিই বোধহয় বিরাট কোহলিকে বোঝা যাবে না।