রাজনৈতিক কারণে এ পৃথিবী এমনিই নানা বিভাজনে কাবু। সাংস্কৃতিক বিপন্নতা তাকে নানা ভাবে পেড়ে ফেলে। সেখানে ক্রীড়া-সংস্কৃতি যেন এক বিকল্প স্পেস তৈরি করতে পারে, যেখানে বিভাজিত পৃথিবীর এক প্রতিনির্মাণ সম্ভব হয়। আর তাই খেলার ফলাফলের থেকেও স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের গুরুত্ব সর্বাধিক। যে কোনও কারণেই যদি সেই সংস্কৃতিতে টানাটানি পড়ে তবে বিশ্বের মানুষই সেই প্রশ্নের মুখে পড়ে, পথিক তুমি কি পথ হারাইছ!
ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে- স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের এটাই বোধহয় সারকথা। খেলা এমনই এক পরিসর যা নিজের জয়কে যেমন উদযাপন করতে শেখায়, তেমনই অন্যের জয়কেও মেনে নিতে শেখায় একই মন নিয়ে। হারের দুঃখ থাকে। তবে তা যেন অন্যের প্রতি বিদ্বিষ্ট না করে তোলে! হার-জয়ের পরিসংখ্যান পেরিয়ে এই যে মানবিকতার ভূমি, তা খেলা তৈরি করে দিতে পারে সহজেই। আর তাই খেলায় স্পোর্টসম্যান স্পিরিট অত্যন্ত জরুরি।
খেলাকে অনেক সময়ই যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করা হয়। তবে, আদতে তা যুদ্ধ কখনই নয়। যুদ্ধের ভিতর যে বিদ্বেষ ও নৃশংসতা, তা খেলায় থাকে না। বরং প্রতিযোগিতার ভিতর দিয়েই এগিয়েও যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা পেরনো এক পরিসরে পৌঁছনো যায়, তাই-ই মূলত ক্রীড়ার মৌলিক চরিত্র-বৈশিষ্ট্য। তাই শুধু জেতা নয়, খেলায় যখনই এই মানবিক ভূমিকা ক্ষুণ্ণ হয়, তখনই ঘনিয়ে ওঠে সন্দেহ, সমালোচনা। সম্প্রতি যেমন একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেই স্পোর্টসম্যান স্পিরিট নিয়েই নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। টাটা স্টিল দাবা টুর্নামেন্টে চতুর্থ রাউন্ডে ২৩ বছর বয়সি উজবেকিস্তানের ইয়াকুববোয়েভের ম্যাচ ছিল ভারতের দাবাড়ু বৈশালী রমেশবাবুর সঙ্গে। সেখানে বৈশালীর সঙ্গে করমর্দনে রাজি হননি ইয়াকুববোয়েভ। কারণ হিসাবে জানিয়েছেন, ধর্মীয় কারণেই তিনি মহিলা খেলোয়াড়ের সঙ্গে করমর্দনে নারাজ। যদিও পরে নেটদুনিয়া আবিষ্কার করেছে যে, অন্যত্র তিনি মহিলা খেলোয়াড়ের সঙ্গে করমর্দন করেছেন। তাহলে কি এখানে প্রতিপক্ষ বৈশালী বলেই তাঁর সঙ্গে হ্যান্ডশেকে রাজি হননি! সে প্রশ্নও উঠেছে। দুটি কারণই খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
যদি ধর্মীয় কারণে উজবেকিস্তানের দাবাড়ু এই কাজ করতে রাজি না হন, তাহলে বুঝতে হবে, ক্রীড়ার ওই মৌলিক জায়গাটিকেই তিনি লঙ্ঘন করেছেন। এই পৃথিবী নানা ভাগে, নানা থাকে ভাগ ভাগ হয়েই থাকে। পার্টি আর পলিটিক্স কখনই যেন মানুষকে বৃহত্তর রাজনীতিতে এনে ফেলতে পারে না। গোটা পৃথিবী যে এক মাত্রা, এক বৈশিষ্ট্যে বাঁধা থাকবে তা হতে পারে না। কিন্তু সেই বৈচিত্রের মধ্যে সমন্বয়ের যে সাধনা, তাই-ই মূলত মানবিকতার অভিমুখ। খেলা চিরকাল সেই প্রসারিত ধারণাটিকেই লালন করে চলে। ধর্মবিশ্বাসে, সংস্কৃতিতে আলাদা আলাদা মানুষ যখন খেলোয়াড় পরিচয়ের জার্সি গায়ে চাপিয়ে নেন, তখন তিনি এই ভাগের রাজনীতি থেকে নিজেকে ঊর্ধ্বেই তুলে আনেন। এক্ষেত্রে উজবেকিস্তানের দাবাড়ু যেন সেই জায়গাটিকেই ভুলে গিয়েছন। তাঁর এই পদক্ষেপ তাই প্রশ্নযোগ্য বটেই। বরং খেলার দীর্ঘ ইতিহাস বলছে সম্প্রদায়গত বিভাজন, দেশে-দেশে বৈরিতা মুছে দিতে সক্ষম হয়েছে খেলা। তা যেমন জাতিগত ঐক্যে বাঁধতে পারে, তেমনই এক বৃহত্তর ঐক্যের দিকেও এগিয়ে দেয়। উজবেকিস্তানের দাবড়ু যেন সেই বড় আকাশটিকেই ধর্মীয় বেড়ার মধ্যে আটকে ফেললেন। তা যে কাম্য নয়, এ কথা বলা জরুরি।
আর যদি প্রতিপক্ষ বৈশালীর সঙ্গে ব্যক্তিগত কারণে তিনি করমর্দন না করে থাকেন, তাহলেও লঙ্ঘিত হচ্ছে খেলোয়াড়ি মানসিকতা। কেননা খেলা আমাদের ব্যক্তির ঊর্ধ্বে উঠতেই শেখায়। প্রতিযোগিতা পেরিয়ে শেখায় সহযোগিতা। যে সহমর্মিতা আমাদের জনজীবনে অত্যাবশকীয় এক অনুশীলন, খেলা তার নিয়মকানুনের মধ্যেই দেয় তার সহজপাঠ। সেখানে প্রতিপক্ষের সঙ্গে ব্যক্তিগত কারণে যদি তিনি সম্মান না জানান, তাহলে স্পোর্টসম্যান স্পিরিট যে ধুলোয় মিশেছে তা বলাই যায়। যদিও পরে দাবাড়ু জানিয়েছেন যে, তিনি যথেষ্ট উদার। বৈশালীকে হাত জোড় করে নমস্কার করার ইচ্ছা ছিল তাঁর। এই সময় বৈশালী করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দেন। ফলত এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় পরিস্থিতি তৈরি হয়। যদিও পৃথিবী যা দেখেছে, তা যেন দেখার কথা ছিল না।
রাজনৈতিক কারণে এ পৃথিবী এমনিই নানা বিভাজনে কাবু। সাংস্কৃতিক বিপন্নতা তাকে নানা ভাবে পেড়ে ফেলে। সেখানে ক্রীড়া-সংস্কৃতি যেন এক বিকল্প স্পেস তৈরি করতে পারে, যেখানে বিভাজিত পৃথিবীর এক প্রতিনির্মাণ সম্ভব হয়। আর তাই খেলার ফলাফলের থেকেও স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের গুরুত্ব সর্বাধিক। যে কোনও কারণেই যদি সেই সংস্কৃতিতে টানাটানি পড়ে তবে বিশ্বের মানুষই সেই প্রশ্নের মুখে পড়ে, পথিক তুমি কি পথ হারাইছ!
উত্তর মেলে না। যদিও উত্তর খুঁজে পাওয়াই একান্ত জরুরি।