এশিয়া কাপের মঞ্চে আবার আমরা সাক্ষী থাকব ভারত-পাক দ্বৈরথের। হয়তো ক্রিকেটীয় ক্ষমতার জেরে পড়শি দেশকে হারিয়েও দিতে পারি। কিন্তু সেই উল্লাসের মুহূর্তে কি আর মনে রাখব নীরজ চোপড়ার মায়ের কথা? রাজনীতির শেখানো বুলিতে আনন্দ প্রকাশ নয়, অ্যাথলিটকে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার শিক্ষা দিলেন যিনি। নীরজকে নিয়ে আমাদের নিরন্তর মাতামতি। মনে কি রাখব তাঁর মায়ের শিক্ষা? আসুন শুনে নিই।
সোনার নজির ছুঁয়েছিল নীরজের জ্যাভলিন। আর সাম্প্রদায়িক উস্কানির জ্যাভলিনটাকে বহুদূর ছুড়ে ফেলে নজিরবিহীন শিক্ষা দিয়েছিলেন তাঁর মা। বিশেষত, আজকের ভারতবর্ষে। যখন আমাদের উল্লাসের ভাষা ক্রমশ অন্যকে পিষে দেওয়ার বুলডোজারে পরিণত হচ্ছে।
আরও শুনুন: Neeraj Chopra: পাক প্রতিদ্বন্দ্বীকে পাশে ডাক, প্রতিযোগিতা পেরিয়ে সোনার মুহূর্ত উপহার নীরজের
ঘটনার কথা তো আমরা প্রত্যেকেই জানি। নীরজ চোপড়া যখন ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতলেন, সারা দেশ আনন্দে উদ্বেল হল। তা হওয়ারই কথা বটে। তবে শুধু সোনাজয়েই যেন সে উল্লাস সীমাবদ্ধ হতে চায় না। তার আরও অন্য উপকরণ চাই। এবং তা ছিল হাতের মুঠোতেই। কেননা পাক প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করে তবেই এসেছে বিশ্বজয়ের মুহূর্ত। অতএব দু-এ দু-এ চার করার সুবর্ণসুযোগ কেউ ছাড়ে! প্রশ্নটা তাই ঘুরে গিয়েছিল নীরজের মায়ের দিকে। তাঁর সন্তান বিশ্বজয়ী হয়েছেন শুধু নয়, পাক-অ্যাথলিটকে হারিয়ে সোনা জিতেছেন। তাতে কি বাড়তি আনন্দের রসদ লুকিয়ে নেই? ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট। স্পষ্টতর হয়েই এসেছিল তার উত্তর। নীরজের মা সরোজ দেবী জানালেন, একজন অ্যাথলিটের সবথেকে বড় পরিচয় এই যে তিনি একজন অ্যাথলিট। তিনি পাকিস্তানের নাকি হরিয়ানার তা বিবেচ্য বিষয় নয়। নীরজ যে সোনা জিতেছেন, এটাই তাঁর কাছে যথেষ্ট আনন্দ-সংবাদ। পাকিস্তানকে হারিয়ে জিতেছেন বলে তা বাড়বে বা কমবে- এরকম কিছু নয়।
আরও শুনুন: ক্যাপ্টেনের আর্ম-ব্যান্ড দিলেন ইয়েডলিনকে, সবারে মান দিয়েই সম্মান ফিরে পান রাজা মেসি
এই ভাবনা খুব স্বাভাবিক। সহজ এবং সত্য। তবু কখনও-সখনও এরকম স্পষ্ট কথা বলে ওঠা জরুরি হয়ে ওঠে। নীরজের মা প্রকৃত অর্থেই ভারতজননী, আর তাই তিনি আমাদের সঠিক অভিমুখে চালিত করেছেন। জয়ের উল্লাসে আমরা এই সহজ সত্যিটা ভুলে যাই যে, ক্রীড়ার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে ঠিকই, কিন্তু তা রাজনীতির নির্ধারিত যুদ্ধক্ষেত্র নয়। অথচ যখনই এরকম পরিবেশ তৈরি হয়, আমরা রাজনীতির শেখানো কথাগুলিই বলতে শুরু করি। আর তাই পাকিস্তানকে হারালে সংবাদের শিরোনামে ‘তোপ’, ‘গোলা’, ‘পাক বধ’ ইত্যাদি শব্দের আমদানি হয়। প্রতিবেশী দেশের কথা নয় সরিয়েই রাখা যাক। এমনকী ঘরোয়া টুর্নামেন্টেও পাশের রাজ্যকে ‘বধ’ ‘দুরমুশ’ ‘চূর্ণ’ না-করলে আমাদের হারিয়ে শান্তি নেই। যেন কুরুক্ষেত্র চলছে! উল্লাসের কি এতখানি নিষ্ঠুর অভিব্যক্তির দরকার আছে! ক্রীড়ানৈপুণ্যে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই কি পর্যাপ্ত আনন্দ নেই! থাকারই কথা। তবু অনেকে খুঁজে যে পায় না, তার কারণ- রাজনীতি। রাজনৈতিক বৈরিতা আমাদের মনের মানচিত্রকে বদলে দেয় অনেকখানি। আর তাই যা ক্ষত, তার প্রকাশেই যেন আমাদের আনন্দ। সে রাজ্য হোক বা দেশ, ইতিহাসের ট্র্যাজেডিকে অস্বীকার করে, মজা-মশকরা যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি এই যুদ্ধের অনুষঙ্গ জাগিয়ে রাখা। ক্রীড়া যে শুধু হারা-জেতার কথা বলে না, আরও বৃহত্তর মেলবন্ধন, মানবিকতার প্রতি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ- সে কথা আমরা অনায়াসে ভুলে যাই। যখন মেসি কিংবা রোনাল্ডোর প্রতিভা বিচ্ছুরণে আমরা বিস্মিত হই, তখন কি আমরা মনে রাখি যে তাঁরা কোন দেশের! যখন আমাদের প্রিয় অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী আমাদের হয়ে ছিনিয়ে আনেন জয়ের গৌরব, তখন কি মনে রাখা উচিত রাজ্যের সীমানা! থাকেও না। আসলে খেলা তো প্রতিযোগিতার সূত্র ধরেই মনকে এই উদার আকাশের সামনে এনে দাঁড় করায়। যেখানে নৈপুণ্যই শেষ কথা। দেশভিত্তিক একটা পরিচয় থাকে বটে, তবে তার থেকেও বড় হয়ে ওঠে দক্ষতা। তবু ওই সর্ষের ভিতরই ভূত। আর তাই কখনও রাজনীতির বয়ান, ক্ষত-খোঁচানো নিষ্ঠুরতাই আমাদের পেয়ে বসে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আমাদের মনে পড়ে যাওয়া উচিত নীরজ চোপড়ার মাকে। তাঁর ওই অমূল্য কথাগুলিকে। যা আসলে সাম্প্রদায়িক উল্লাসের জ্যাভলিনকে বহুদূর ছুড়ে ফেলে দেয়। এশিয়া কাপের মঞ্চেই হয়তো সেরকম মুহূর্ত আসবে। সোনার ছেলের মা-কে আমরা কতটা শ্রদ্ধা করি, হয়তো আগামির জয়োল্লাসেই তা লেখা থাকবে।
নীরজকে আমরা দেশের সেরা অ্যাথলিটের সম্মান দেব। তাঁকে নিয়ে মাতামাতি করব নিরন্তর। শুধু আবার যখন এরকম উল্লাস প্রকাশের মুহূর্ত আসবে, তখন আমাদের চোখের সামনে কি একবারও ভেসে উঠবে তো নীরজ চোপড়ার মায়ের মুখ? নিজেদের বিবেক-বিবেচনার কাছেই বরং তোলা থাক এই প্রশ্নটাই।