ব্যর্থতা বা সাফল্য, শামি মানেই সংখ্যালঘু! বিভাজনের ফাঁদে তবে কি ধর্ম হারাল ক্রিকেট? এই তুমুল সাফল্যের দিনেও তিনি মাঠে যে বসে পড়েছেন তা ক্লান্ত হয়ে নাকি প্রার্থনা করার জন্য, তা নিয়ে চলছে তর্ক। ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে যাঁরা ধর্মীয় ভেদাভেদকে পেরিয়ে এক উদার আকাশের স্বপ্ন আজও বুকে লালন করেন, তাঁদের কাছেও অনিবার্য হয়ে উঠছে মহম্মদ শামির ধর্মের প্রসঙ্গ।কেন? শুনে নিন।
মহম্মদ আজহারউদ্দিনের কবজির মোচড়। কিংবা ভিভিএস লক্ষ্মণের হাতের তাস! ক্রিকেটের ক্যানভাসে আঁকা অনবদ্য শিল্পসুষমা। যেন বিস্ময়ের জাদু মাখানো অপূর্ব কোনও চিত্রকলা। তুলনামূলক আলোচনাও চলতে পারে। রানের হিসাবশাস্ত্র বাদ দিলে, নন্দনতত্ত্বের নিরিখে কে কোন অবস্থানে, তা নিয়ে। কিংবা ধরা যাক পয়েন্টে দাঁড়িয়ে যুবরাজ সিং-এর উড়ন্ত পাখি হয়ে ওঠার গল্প। অথবা মহম্মদ কাইফের অবিশ্বাস দৌড়ে বল তালুবন্দি করে নেওয়ার জ্যান্ত দৃশ্য। কে বেশি জন্টি রোডস্! তাই নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে মৃদু গুনগুন, চাপা ফিসফাস। সেসব তো মাত্র এই সেদিনের কথা। ক্রিকেট সেদিনও ছিল শুধু ক্রিকেটেই। ক্রিকেটীয় উৎকর্ষই বিচারের একমাত্র মাপকাঠি। কেউ বোধহয় ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেননি সেদিন যে, এই আলোচনার ভিতর ঢুকে পড়তে পারে ক্রিকেটারদের ধর্ম। ‘রিলিজিয়ন’ অর্থে ধর্ম শব্দের যে প্রয়োগ, তা এই সেদিনও ভারতবর্ষের ক্রিকেটকে ততখানি বিচলিত করেনি। ক্রিকেটপ্রেমীর পড়ার ঘরের দেওয়ালে যাঁদের ছবি টাঙানো, বইয়ের মলাটে যে ক্রিকেটারদের মুখের স্টিকার, পঞ্চাশ পয়সার পোস্ট কার্ড সাইজ ছবিতে যে ক্রিকেটারদের বন্দনা- তাঁদের ধর্ম কে আর কবে জানতে চেয়েছে! এই সেদিনও ভারতবাসীর কাছে ক্রিকেটই ছিল ধর্ম।
আরও শুনুন: বাংলা জানেন ধোনি, বোঝেননি বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা! ফল কী হয়েছিল?
ক্রমে সেই ভারতবর্ষ বদলে গেল। সবকিছু পিছনে ফেলে ধর্ম আর ধর্মভিত্তিক পরিচয়, আলোচনাই চলে এল ফ্রন্ট সিটে। ফলত, আজ যখন বিশ্বকাপ জুড়ে একটু একটু করে লেখা হচ্ছে শামি-রূপকথা, তখনও এড়ানো গেল না সংখ্যালঘু প্রসঙ্গটিকে। চলতি বিশ্বকাপে শামির হাত যেন সোনার আখরে লিখে চলেছে ক্রিকেটের, বিশেষত পেস বোলিং-এর মুগ্ধ পদাবলি। বিশ্ব ক্রিকেট তা নিঃসন্দেহে তা চিরকাল মনের মণিকোঠায় তুলে রাখবে। ভারতীয় পেস বোলিং নিয়ে আগামীর ইতিহাস যখনই নিজস্ব পাঠাগারে বসে দু-দণ্ড মাথা ঘামাবে, তখন অনিবার্য হয়ে উঠবেন মহম্মদ শামি। তবে, শামির সেই রূপকথাকে কি আমরা এটুকুতেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারছি! তাঁর সিম পজিশন, দুরন্ত গতি, নিখুঁত লাইনের ভিতর সৃষ্টি আর নির্মাণের যে বিমূর্ত খেলা, তা নিয়ে কি আমরা ততখানি মগ্ন থাকতে পারছি! পারছি না। কেন-না আমাদের চোখের সামনে অগুনতি দৃশ্যের চলচ্ছবি। যা আমাদের কেবলই জানাচ্ছে, যে, এই মহম্মদ শামিকেই ক-দিন আগেই তাঁর ধর্মের কারণে হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। তাঁকে দেখে কারা যেন ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তুলেছিলেন! কারণটা আজ আর কারও কাছে অজানা নয়। খেলার ভালো-মন্দ নয়, শামি যে ইসলাম ধর্মাবলম্বী, তাঁর সেই সংখ্যালঘু পরিচয়ই হয়ে উঠেছে মুখ্য। এমনকী, এই তুমুল সাফল্যের দিনেও তিনি মাঠে যে বসে পড়েছেন তা ক্লান্ত হয়ে নাকি প্রার্থনা করার জন্য, তা নিয়ে চলছে তর্ক। ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে যাঁরা ধর্মীয় ভেদাভেদকে পেরিয়ে এক উদার আকাশের স্বপ্ন আজও বুকে লালন করেন, তাঁদের কাছেও অনিবার্য হয়ে উঠছে মহম্মদ শামির ধর্মের প্রসঙ্গ। না, তাঁরা বিভাজনকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন না। বরং তার বিরুদ্ধতার পথটিতেই হাঁটছেন। তবে ঘটনা এই যে, আজ আমরা এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছি যে, ওই ধর্মীয় প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আমাদের আলোচনা আর এগোতে পারছে না। বদলে যাওয়া দেশের সংস্কৃতি যে ঠিক কবে থেকে সবকিছুকে ধর্মের তুলাদণ্ডে মাপতে শেখাল, তা যেন আমরা ঠাহরই করতে পারিনি। যখন খেয়াল হল, তখন আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে গিয়েছে আমাদের মানবিকতা আর নিরপেক্ষতার সিকি-আধুলি। আমরা সবিস্ময়ে খেয়াল করলাম, ক্রিকেটের ধর্ম ছাপিয়ে ধর্মের তির এসে বিদ্ধ করেছে ক্রিকেটের অন্তরাত্মা।
এই যে শামির তুঙ্গ সাফল্যের দিনেও তাঁর সংখ্যালঘু পরিচয়ের কথা নানা ভাবে ফিরে আসছে, এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আর কিছু হয় না। যা ছিল চূড়ান্ত অনভিপ্রেত, তাই-ই ক্রমে হয়ে উঠল জরুরি। এই বোধহয় ধর্ম-কারবারিদের সাফল্য। ধর্মবিশ্বাসের কারণে যাঁকে কটূক্তির শিকার হতে হয়েছে, তাঁর সাফল্যের দিনেও সেই অস্বস্তি আড়াল করা যায় না। অবধারিত ভাবে তাই চলে আসে মেরুকরণের ভারতবর্ষের কথা। যে ভারতবর্ষ ধর্মের রোদচশমা চোখে দিয়ে ক্রিকেট দেখতে শিখেছে। এমনটা কি হওয়ার কথা ছিল? নিজেদের দিকে এ প্রশ্নের অভিমুখ ফিরিয়ে নিলে, আমরা হয়তো বুঝতে পারব, এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। দেশের বাতাবরণে যখন ধর্মীয় উন্মাদনা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, আমাদের স্বচ্ছ ভাবনায় যখন ধর্মীয় ভেদাভেদের কুয়াশা, তখন জল যে দিকেই গড়াবে না জানার তো কোনও কারণ নেই। তবু এখনও যেন সে কথা মেনে নিতে ইচ্ছে করে না। শামি তাঁর সাফল্য-ব্যর্থতা মিলিয়েই, একজন ক্রিকেটার হিসাবে যে জায়গায় পৌঁছনোর সেখানে পৌঁছে যাবেন। দেশ এবং বিশ্বের ক্রিকেট ইতিহাস তাঁকে সেভাবেই মূল্যায়ন করবে আগামীতে। কিন্তু এই দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের, শামির রূপকথার দিনেও যাঁদের দুর্ভাগ্যক্রমে সেই ধর্মের কাছেই ফিরতে হল, তাঁদের পরিত্রাণ কোন পথে! কবে আবার সব ঝড় থেমে গেলে, ধর্ম নয়, ভেদ নয়, তাঁরা আবার ফিরতে পারবেন ক্রিকেট, নিছক ও নির্ভেজাল ক্রিকেটের কাছেই? সে উত্তর জানা নেই। শুধু এই অতিকায় জালে আটকে পড়া সময়ের ভিতর বসে ছটফট করতে করতে তাঁরা বড়জোর বলে উঠতে পারেন, শুধু ধর্ম ধর্ম তোমার ক্রিকেট নেই ভারতবর্ষ!