তখন হাতের সামনে বিকল্প কম। কার্টুন ছবিও হাতে গোনা কিছু। টিভি সিরিয়াল, সে তো ‘দরজা বন্দি টিভি’র ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা ‘বস্তু’। আর এই দরজা বন্দি টিভি খুলেই পরিচয় হয় কোঁকড়ানো চুলের ছোট্ট ছেলেটির সঙ্গে। শচীন তেন্ডুলকর। ছোটবেলার সেই স্মৃতি বড়বেলায় ফেরাল মাস্টার্স লিগ। ফিরে দেখলেন প্রসেনজিৎ দত্ত।
এক যে ছিল সময়। তখন হাতের সামনে বিকল্প কম। কার্টুন ছবিও হাতে গোনা কিছু। টিভি সিরিয়াল, সে তো ‘দরজা বন্দি টিভি’র ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা ‘বস্তু’। আর এই দরজা বন্দি টিভি খুলেই পরিচয় হয় কোঁকড়ানো চুলের ছোট্ট ছেলেটির সঙ্গে। শচীন তেন্ডুলকর। কে জানত, একদিন সেই ছোট্ট ছেলেটিই দুনিয়া কাঁপাবে! এই সব সুখস্মৃতিকে অনেকেই ‘নস্টালজিয়া’ বলে। যদিও প্রতিবেদকের কাছে তা ‘নব্বইয়ের নকশা’। সেই নকশাই যেন ফুটে উঠছিল বার বার। মাস্টার্স লিগ দেখতে দেখতে।
আসলে আমরা সত্যিই নস্টালজিয়ার রূপকথায় আক্রান্ত। আর যা কিছু নস্টালজিয়াময়, তা ফিকে নয়। তাই ছিয়ানব্বইয়ের টাইটান কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির সঙ্গে মাস্টার্স কাপ হাতে নেওয়া শচীনের অমিল নেই। বছর তিরিশেক আগেও সে ক্যাপ্টেন। আজও তাই। পার্থক্য একটাই। তখন পাড়ায় থাকা একজনের বাড়িতে টিভি। সেখানেই উপচে পড়ত ভিড়। বৈঠকখানাটাই হয়ে উঠত আস্ত গ্যালারি। আর এখন হাতের মুঠোফোনেই দেখা যায় ছোটবেলার নায়কদের। তবু মধ্যিখানে বাকিটা সময় কেমন যেন দুয়োরানি। একানব্বইয়ে অর্থমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং। তিনি পেশ করেছিলেন যুগান্তকারী এক বাজেট। বাজেট বক্তৃতার সময় তিনি ফরাসি কবি, রাজনীতিবিদ ও জাতীয় পরিষদের প্রাক্তন সদস্য ভিক্টর হুগোকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর কোনও শক্তি এমন একটি নতুন ধারণাকে আটকাতে পারে না, যার আসার সময় এসেছে।’ তেমনই এই শচীন ও তার উইলো ব্যাটের রূপকথারা। যার আগমনে ক্রিকেটটাকেই বদলে গিয়েছিল।
এই বদল কি আর সহজে আসে! ততদিনে ‘দানব’ ক্যারিবিয়ানদের হারিয়ে বিশ্বজয় করেছে কপিল দেবের ভারত। রবি শাস্ত্রী অডি গাড়িতে বসে মাঠও ঘুরে ফেলেছেন। কিন্তু এরপরেই সেই বিখ্যাত ‘শচীন আয়া রে, হু শচীন আয়া রে ভাইয়া, হোশ উড়ানে আয়া, ছক্কে ছুডানে আয়া, ম্যায় দিল তুঝকো দিয়া’। ব্যস বদলের শুরু। কিন্তু আমাদের মধ্যবিত্ত মনেরও কি বদল ঘটেছিল? মধ্যবিত্ত মন তো ক্রিকেটারদের কখনও পালিশ করা চোখে দেখতে শেখায়নি। সেই না-দেখা না-সম্ভাবনাময় সময়ের ফাঁক দিয়েই অজস্র ক্যাচ মিস, মিস ফিল্ডিংয়ের কিসসা মনকে পীড়া দিত। সেই কারণেই হয়তো ছিয়ানব্বই বিশ্বকাপে শচীনের ৫২৩-ও চোখ থেকে জলভরা মেঘের আষাঢ় মুছিয়ে দিতে পারেনি।
আমরা হেরেই যেতাম। হয়তো পরাজয়ই জীবনের সার খুঁজে পেতে সাহায্য করত। তাই একটামাত্র, কেবল একটামাত্র জয় বহু পরাজয়কে ভুলিয়ে দিতে পারত। ঠিক এই জায়গাতেই শচীনের রূপকথা শুরু। শচীন খেললে আমরাও খেলি, শচীনের একটা কভার ড্রাইভ যেন অসুখের মলম। সেই কভার ড্রাইভ আজও অবিকল। ফাইনালে রবি রামপালের বোলিং সামলাতে শচীন যখন স্টান্ট নিচ্ছিলেন, একবারের জন্য মনে হয়নি মধ্যিখানে তিনটে দশক পেরিয়ে গেছে। সময় সেখানে থমকে গেলেও নতুন। সেখানেই রূপকথার আয়ু। নস্টালজিয়ার জন্ম।
শচীন ছাড়াও ক্রিকেটের আর-এক রাজপুত্র খেলেছেন মাস্টার্স লিগে। তিনি ব্রায়ান লারা। বোন উচ্চারণ ভুল করে তাকে ডাকত ‘লালা’। ফাইনালে লারার ব্যাট থেকে মাত্র ৬ রান এলেও একটা বাউন্ডারি তাঁর ব্যাটের ছোঁয়ায় সীমানা পেরিয়ে গিয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট রাজপুত্র। আশ্চর্য এক স্টান্স। অসামান্য এক ধৈর্য। দীর্ঘ ইনিংস ছড়িয়েছিল টেস্ট ক্রিকেটের পাঁচদিনে তখন। আজকের মতো ২-৩ দিনে ফয়সালা হয়ে যেত না। ব্যাকফুট পাঞ্চ কিংবা ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে কভারের ওপর দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া বল, এসে পড়েছিল আমাদের যৌথ টেলিভিশনের দুনিয়ায়। যে দুনিয়া ঝিরঝির করলে, ছাদে উঠে ঠিক করতে হত অ্যান্টিনা। অ্যান্টিনা কী করে যেন অ্যান্টিক হয়ে গেল দেখতে দেখতে। মাস্টার্স লিগের ফাইনাল ঠিক যেন সেই নকশা আঁকা ছোটবেলা। সেই অবিমিশ্র, বিশুদ্ধ, একনিয়মানুসারী, রূপান্তরহীন। দূরে কোথাও কেউ অ্যান্টিনা নাড়িয়েছে ভাগ্যিস, আরেকবার তাই দেখা গেল ক্রিকেট বলের অমলিন বাউন্ডারি স্পর্শ। কয়েকজন মাত্রই জানতাম, সেই বাউন্ডারি আসলে আমাদের ছোটবেলা, বারবার তা স্পর্শ করে আসছিল শচীন-লারার ব্যাট ছোঁয়া স্মৃতির বল, সম্বল।