ধোনি জানেন, জীবন ক্রিকেটের থেকেও বৃহত্তর। তা-ই ঠিক সময়ে নিজের ভিতর ক্রিকেটের সুইচটা তিনি অফ করে দিতে পারেন। আমরা তাঁকে এই জন্যই এত নির্লিপ্ত দেখি। ক্যাপ্টেন কুল হিসাবেই তাঁর খ্যাতি। এই নির্লিপ্তি আসলে ক্রিকেট আর জীবনের সরু সাঁকোপথ। যা একা একা পেরিয়ে আসেন ধোনি। ধোনিকে তাই জার্সির নিশান উড়িয়ে নিজেকে মেলে ধরতে হয় না, কিংবা আলাদা করে অ্যাগ্রেসিভনেসের বিজ্ঞাপন হয়ে উঠতে হয় না। তিনি নীরবেই স্টাম্প তুলে নিয়ে ফিরে যেতে পারেন ক্রিকেট থেকে জীবনের ক্রিজে। ধোনি ঠিক এখানেই ব্যতিক্রমী। ভারতীয় ক্রিকেটে তিনি যেন নির্জন এককের গান।
মানুষটা ভারতীয় ক্রিকেটকে দিয়েছেন তাঁর সর্বস্ব। আর ওই নির্লিপ্ত দু-চোখেই বুঝি বা ভারতীয় ক্রিকেট দেখেছিল তার অনিবার্য সর্বনাশ। ‘এ সংসারের নিত্য খেলায় প্রতিদিনের প্রাণের মেলায়/ বাটে ঘাটে হাজার লোকের হাস্য-পরিহাস’-এর মাঝখানে জেগে থাকে যে অমোঘ সর্বনাশ। যে সর্বনাশের খোলা হাওয়ায় ডুবতে রাজি ক্রিকেটকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নেওয়া অগণন মানুষ। আর ভারতীয় ক্রিকেট! ৭=১-এর রহস্য-সমীকরণের সমাধান হাতে ধোনিকে রেখেই তো সে কষে গিয়েছে গত দু-দশক। সন্দেহ নেই, আগামীতেও ভারতের ক্রিকেটের সামনে যা সব জটিল-কুটিল অঙ্ক আসবে, ধোনিকে ধ্রুবক ধরেই তা সমাধানে মন দিতে হবে। ভারতীয় ক্রিকেটকে সর্বস্ব দেওয়া মহেন্দ্র সিং ধোনি তাই সেই অমোঘ সর্বনাশ যা থেকে পরিত্রাণ নেই, নিষ্কৃতি চায়ও না দেশের ক্রিকেট।
কী করেছেন মানুষটা? অধিনায়ক হিসাবে এমন সব সাফল্যের সিঁড়ি-ভাঙা অঙ্ক অবলীলায় কষে গিয়েছেন যে,সমাধানের পাতায় কেবল সাফল্যের পরিসংখ্যানই জমা হয়েছে। এক একটা ক্ষেত্রে ক্রিকেটের শীর্ষবিন্দু যেন ধোনির অপেক্ষাতেই থেকেছে বহুকাল, যেভাবে চাঁদের মাটি অপেক্ষায় ছিল নীল আর্মস্ট্রং-এর। সেই একটা ছোট পদক্ষেপ মানব সভ্যতার যেমন ছিল বড় উল্লম্ফন, ধোনির এক-একটা আচমকা সিদ্ধান্তও সেভাবেই ভারতীয় ক্রিকেটকে এগিয়ে দিয়েছে এক দশক। কপিল দেবের পর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে কোন পথে এগোত দেশের ক্রিকেট! যদি না থাকতেন ধোনি নামের এক ভারতপথিক! হয়তো বলা যেতে পারে যে, অধিনায়কের আসন তো শূন্য থাকত না। কেউ-না-কেউ এসে ঠিক দেশের হাল ধরতেন। তবে এ কথা প্রায় অসংকোচেই বলা যায়, তাঁরা কেউই ধোনি হতেন না। কেন-না ধোনি নামের ঘটনাটি এক যুগে একবারই সম্ভবপর হয়ে ওঠে। ইতিহাস বোধহয় এক্ষেত্রে নিজেকে পুনরাবৃত্ত করে না। আসলে, সাফল্যের হিসাবখাতা খুলে ধোনিকে বিচার করতে বসা নির্বুদ্ধিতারই শামিল। ধোনি তাহলে কোথায় অনিবার্য হয়ে উঠছেন? ওই যে ধোনি বলেন, যতক্ষণ না পূর্ণচ্ছেদ, ততক্ষণ বাক্য সম্পূর্ণ হচ্ছে না; ঠিক এই দর্শনেই ধোনি ক্রিকেট আর জীবনকে মিলিয়ে দিতে পারেন। তাঁকে সর্বকালের সেরা ফিনিশার বলা হয়। শুধু ক্রিকেটীয় গণ্ডিতে যদি ধোনির এই দর্শনকে আটকে রাখা হয়, তাহলে প্রকৃতপক্ষে মহীরুহকে বনসাই করেই দেখা হবে। আসলে এ তো জীবনেরই অমোঘ শিক্ষা। ধোনি জীবন থেকে শিখতে শিখতেই এগিয়েছেন।
ছোট্ট এক শহরের বুকে জন্ম নেওয়া বড় স্বপ্ন হয়েই তিনি এসেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের প্রসারিত দিগন্তে। তাঁর পূর্বসুরির নেই ক্রিকেটের কৌলীন্য। ছিল শুধু প্রতিভা আর আত্মবিশ্বাস। লম্বা লম্বা চুলের সেই নতুন হাওয়ার দিকে সেদিন তাকিয়ে ছিল গঞ্জ-শহরে স্বপ্ন বুকে আঁকড়ে থাকা অসংখ্য ক্রিকেটপ্রেমী। তারপর গঙ্গা-যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। ধোনির সেই লম্বা চুলও সময়ের নিয়মে মিলিয়ে গিয়েছে। ঝাড়খণ্ডের মহেন্দ্র সিং ধোনি থেকে তিনি হয়ে উঠেছেন ভারতীয় এবং বিশ্ব ক্রিকেটের অবিসংবাদিত ‘এমএসডি’। আর এই প্রায় অলৌকিক রূপান্তরই যেন বেঁধে দিয়েছে ধ্রুবপদ। দিয়েছে বিশ্বাসের বীজমন্ত্র। সে-মন্ত্র জানায়, নিজের উপর বিশ্বস হারানো পাপ। ধোনি বলবেন, জীবনে ভুল হয়ে যেতেই পারে। কিন্তু ভুলের পুনরাবৃত্তি কোনও কাজের কথা নয়। আসলে জীবনটা শুধু ঠিক-এর মাইলস্টোন নয়। সেখানে ভুল থাকে। আর ভুল থেকেই ঠিকের খোঁজ মেলে। ধোনির অগ্রজ আর সতীর্থরা বলেন, ম্যাচের আগে মানুষটা আশ্চর্যজনক ভাবে নির্লিপ্ত থাকেন। অন্য অধিনায়কদের মুখের রেখায় যখন চাপের স্বেদবিন্দু ফুটে ওঠে, যার প্রভাব পড়ে বাকিদের উপর, ধোনির চোখে-মুখে তখন বরফশীতলতা। যেন কিছুই হয়নি, কিছুই বেচাল হওয়ার নেই। প্রস্তুতি যখন নেওয়া আছে, তখন ভাবনা কীসের! তারপর ম্যাচের ঠিক আগেই কোন এক অদৃশ্য সুইচ অন করে মাহি চলে যান খেলার ভিতর। মাঠের ভিতর তিনি অন্য মানুষ। হয়তো অল্প রানে পুঁজি সম্বল করে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন, কিন্তু চাপ এমন বাড়াচ্ছেন যে, বিপক্ষের মনে হচ্ছে রানের পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে সামনে। মিড উইকেট থেকে ধোনি যদি ডিপে ফিল্ডার নিয়ে যান, নিশ্চিতই তার তিন বল পরে কিছু একটা ঘটবেই। সে পরিকল্পনা তিনি আগেই কষে রেখেছেন। স্নায়ুর চাপে পড়ে বিপক্ষ প্রায়শই ভুল করে ফেলে। আর যদি না-ও করে গ্লাভস হাতে ধোনি এমন অবিশ্বাস্য স্টাম্পিং করলেন যে, গোটা টিমটাই চলে গেল আত্মবিশ্বাসের উত্তুঙ্গ শিখরে। রান তাড়া করতে নেমে ধোনি এমন অবিশ্বাস্য শট খেলবেন আর ম্যাচ জিতিয়ে ফিরবেন যে, ক্রিকেটের ব্যাকরণ দু-বার ঢোঁক গিলবে। ভাববে, এমনটাও সম্ভব! কিন্তু ধোনিকে যদি এর ফর্মুলা জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে তিনি নিজেও হয়তো তা বলতে পারবেন না। কেননা ধোনি নামক এই ব্যবস্থাটির কোনও ম্যানুয়াল নেই। ধোনি পরিস্থিতির সঙ্গে নিজের বিবর্তন ঘটান আর তাতেই ঘটে যায় যোগ্যতমের উদ্বর্তন। জীবন তো এরকমই। তার কোনও নকশা নেই। সে এমন এক স্কেচ যাকে মুছে আবার নতুন করে আঁকা যায় না। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে বেঁচে থাকার মধ্য দিয়েই জীবন প্রকৃত প্রস্তাবে জীবন্ত হয়ে ওঠে। ধোনির দর্শন ঠিক যতখানি ক্রিকেটের, ততখানি জীবনেরও। অধিনায়ক অনেকেই হন, নেতৃত্বের গুণে হয়তো অনেকেই এগিয়ে থাকেন, কিন্তু ধোনি যেভাবে ক্রিকেট আর জীবনকে এক দর্শনে মিলিয়ে দিতে পারেন, তার সমতুল কোনও উদাহরণের দেখা মেলে না।
কিন্তু ধোনি জানেন, জীবন ক্রিকেটের থেকেও বৃহত্তর। তা-ই ঠিক সময়ে নিজের ভিতর ক্রিকেটের সুইচটা তিনি অফ করে দিতে পারেন। আমরা তাঁকে এই জন্যই এত নির্লিপ্ত দেখি। ক্যাপ্টেন কুল হিসাবেই তাঁর খ্যাতি। এই নির্লিপ্তি আসলে ক্রিকেট আর জীবনের সরু সাঁকোপথ। যা একা একা পেরিয়ে আসেন ধোনি। ধোনিকে তাই জার্সির নিশান উড়িয়ে নিজেকে মেলে ধরতে হয় না, কিংবা আলাদা করে অ্যাগ্রেসিভনেসের বিজ্ঞাপন হয়ে উঠতে হয় না। তিনি নীরবেই স্টাম্প তুলে নিয়ে ফিরে যেতে পারেন ক্রিকেট থেকে জীবনের ক্রিজে। আসলে ধোনি ঠিক এখানেই ব্যতিক্রমী। ভারতীয় ক্রিকেটে তিনি যেন নির্জন এককের গান। জীবনের আদল ক্রিকেটে মিশিয়েও যেমন দিতে পারেন, তেমন ক্রিকেট থেকে জীবনকে আলাদাও করে ফেলতে পারেন। ক্রিকেট যে দেশে ধর্মের সমান, সেখানে ধোনি যেন এই ভারসাম্য রক্ষা আর স্বতন্ত্রীকরণের সার্থক পথপ্রদর্শক। ক্রিকেট তিনি জীবন দিয়েই খেলেন, কিন্তু ক্রিকেট দিয়ে জীবনকে কষতে যান না। ধোনি তাই ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে এক রহস্য, প্রহেলিকার সমান।
আর ঠিক এই কারণেই ধোনি ভারতীয় ক্রিকেটের অনিবার্য সর্বনাশ। যা যা তিনি করে দিয়ে গেলেন তার তুলনা আসবে প্রতি পদেই। যা যা তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেলেন তা-ও মাইলফলক হয়ে থাকবে। ভারতীয় ক্রিকেট আগামীতে প্রতি পদকেই খুঁজবে ধোনিকে। সাফল্যের পরিসংখ্যানের কথা যদি ছেড়েই দেওয়া যায়, যে কোনও সংকটের মুহূর্তে ধোনি-দর্শনের দিকেই ঝুঁকতে চাইবে ক্রিকেট ও দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। আর তখনই হয়তো বোঝা যাবে, ধোনির কোনও দ্বিতীয় হয় না। হবেও না। ভারতের ক্রিকেট নিজের মতো করেই এগিয়ে যাবে। আইপিএল-এ ধোনির জন্য আবার গ্যালারিতে পীতসাগরের ঢেউ উঠবে কি-না, সে উত্তরও আপাতত অজানা। শুধু জানা কথা এই যে, ধোনি হলেন সেই সর্বনাশ, দেশের ক্রিকেট প্রহরশেষের আলোয় রাঙা যে কোনও চৈত্রমাসে আবারও যার দিকে চোখ রাখতে দ্বিধা করবে না।
ভারতীয় ক্রিকেট জানে, সকল নিয়ে তো বসে থাকা যায় এমন সর্বনাশের আশাতেই।