মেসি-ম্যাজিকে মুগ্ধ গোটা বিশ্ব। জয়ধ্বনি উঠছে তাঁর নামেই। আর সেই আলো থেকে একটু দূরে একেবারে ছাপোষা মানুষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর একজন। লিওনেল স্ক্যালোনি। তিতে, দেশঁ, এনরিকে, ভ্যান গলের মতো জৌলুস নেই তাঁর। চর্চাও তাঁকে নিয়ে তুলনায় কম। কিন্তু তাতে কী! মগজাস্ত্রের নিখুঁত নিশানায় ঘায়েল করছেন একের পর এক প্রতিপক্ষকে। মেসি-আলোয় ঝলমলে পৃথিবীতে তাই কিছুতেই সরিয়ে রাখা যায় না স্ক্যালোনির গল্প। তাঁর কথাই শোনালেন, অর্পণ গুপ্ত।
এই বিশ্বকাপের নক্ষত্র একজনই। লিওনেল। মেসিকুলোদ্ভব। তবে, এই কুল ছাপিয়ে আছেন আরেক লিওনেল। ছাপোষা লিওনেল, সাদামাটা লিওনেল, সাইডলাইনের ধারে শান্ত হয়ে বসে থাকা ছিপছিপে সেই লিওনেল অনেকটাই চাপা পড়ে গিয়েছেন তাঁর নেমসেকের হাজার হাজার ওয়াটের আলোয়। মেসির বিশ্বকাপের এই আলো ছড়ানোর পিছনে নিঃশব্দে জ্বালানির জোগান দিয়েছেন যিনি, তিনি আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্ক্যালোনি।
আরও শুনুন: ২৪ বছর বিশ্বকাপে অংশ নেয়নি আর্জেন্টিনা, কিন্তু কেন?
এখন ভাবলে একটু অদ্ভুতই লাগে। স্ক্যালোনি যখন আর্জেন্টিনার দায়িত্ব নিলেন, তখন তো এসব চিত্রনাট্য যে কোনোদিন লেখা হতে পারে, এ কারও দূরকল্পনাতেও আসেনি। আসার মতো পরিস্থিতিও ছিল না৷ ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হট সিটে হোর্খে সাম্পাওলি৷ দুঁদে ম্যানেজার। যিনি চিলিকে কোচিং করিয়ে কোপা জিতিয়েছেন, বিশ্বকাপে চমকে দিয়েছে চিলি। সেই সাম্পাওলির অ্যানিমেটেড হয়ে সাইডলাইনের ধারে ঘুরে বেড়ানোর সময় বেঞ্চের এক কোণে বসে থাকতেন তাঁর এই সহকারী ছেলেটি। স্ক্যালোনি। ভাগ্যের কী পরিহাস! চূড়ান্ত সফল কোচ সাম্পাওলি কিন্তু আর্জেন্টিনাতে একেবারে ফ্লপ। গ্রুপ স্টেজ বিদায় কোনোমতে ঠেকিয়ে, সুপার সিক্সটিনেই বাদ। সাম্পাওলিকে সরে যেতে হল। আর্জেন্টিনার রাস্তা জুড়ে ক্ষোভ, উত্তপ্ত পরিস্থিতি। এর মাঝে আর্জেন্টাইন ফুটবল আসোসিয়েশন স্পষ্ট করে দিল যে, এই মুহূর্তে মোটা অঙ্কের মাইনে দিয়ে কোচ আনার বাজেট তাঁদের নেই। ইন্টেরিম বা অন্তর্বর্তী কোচ হিসেবে তরুণ স্ক্যালোনি কিছুদিন কাজ করবেন, তারপর নতুন কাউকে আনা হবে। সেই শুরু হল এক নতুন অধ্যায়।
আরও শুনুন: বিছানার নিচে জুতোর বাক্সে লুকোনো ছিল বিশ্বকাপের ট্রফি, কিন্তু কেন?
আসলে এত কম পারিশ্রমিকে পেকেরম্যানের দলের এই আনকোরা খেলোয়াড়টি দেশের ফুটবলের কোচিং করানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তা অভাবনীয়। স্ক্যালোনির হাত ধরে চলে যাওয়া যাক ২০১৯ কোপা আমেরিকায়। আর্জেন্টিনা শুরু করল ছন্নছাড়া ভাবে, স্ক্যালোনির কোচিং একেবারে খাদের কিনারে। অথচ, টুর্নামেন্টে ম্যাচ গড়াতেই আর্জেন্টিনা বদলাল, আর্জেন্টিনা দুরন্ত খেলেও সেমিফাইনালে ছিটকে গেল ব্রাজিলের কাছে হেরে। স্ক্যালোনি ওই মুহূর্ত থেকে বুঝেছিলেন, দলকে তৈরি করতে হবে, এ দলের ক্ষমতা আছে। ২০১৮-এর দলে আমূল বদল আনলেন, স্পেনে দীর্ঘদিন খেলা এবং কোচিং শেখার সুবাদে স্ক্যালোনি পালসটা বুঝে নিলেন। এরপর শুরু হল এক অবিশ্বাস্য জার্নি। ২০২১ কোপা আমেরিকাতে আর্জেন্টিনা খুঁড়িয়ে শুরু করেও, ম্যাচ জিতল। খুব দৃষ্টিনন্দন ফুটবল না খেলেও কীভাবে কার্যকরী ফুটবল খেলতে হয়, কীভাবে প্রতিপক্ষ বুঝে কখনও ৩ ব্যাক কখনও ৪ ব্যাকে যেতে হয়, কীভাবে মিড ওভারলোড করতে হয় তা ইনজেক্ট করলেন দলে। ফাইনালে, দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রাজিল ধরাশায়ী, সৌজন্যে স্ক্যালোনির নাগপাশ। তারপর ইতালিকে হারিয়ে ফাইনালিস্মা। বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকেই তাই আর্জেন্টিনাকে নিয়ে হইচই। অথচ ফ্লিক, সাউথগেট, দেশঁদের মতো কোচেদের থেকে প্রায় অর্ধেক স্যালারিতে (২.২ মিলিয়ন) আজও কাজ করে যাচ্ছেন স্ক্যালোনি।
আরও শুনুন: বার দুয়েক চুরি হয়েছিল বিশ্বকাপের ট্রফি, উদ্ধারের গল্প হার মানায় সিনেমাকেও
বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ হারের পর স্ক্যালোনির চোয়াল শক্ত। বললেন, ‘আমরা কিছু ভুল করেছি। আমাদের ওপর একটু ভরসা রাখুন। আমরা শুধরে নেব…’; শুধরোলেন সে ভুল৷ আর আর্জেন্টিনা ট্যাকটিকাল ব্রিলিয়ান্সে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেল ফাইনালে। কোয়ার্টার ফাইনালে লুই ভ্যান হালের মতো দুঁদে কোচের ৩ ব্যাক সিস্টেমের পালটা হিসেবে স্ক্যালোনি যেভাবে লিসান্দ্রোকে নামিয়ে ৩ ব্যাকে গেলেন, যেভাবে মলিনাকে ওপরে তুলে গোলের রাস্তা পরিস্কার করলেন তা চমকে দিল ফুটবল বিশেষজ্ঞদের। ‘স্ক্যালোনিজম’-কথাটা প্লেয়াররা মজা করে বলে ড্রেসিংরুমে। আর স্ক্যালোনিজমের সর্বোত্তম প্রকাশ ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ। জলাটকো দালিচের মতো বিদগ্ধ কোচকেও ট্যাকটিক্সে মাত করলেন স্ক্যালোনি!
পরিসংখ্যান? ৫৫ ম্যাচ খেলে ৩৯ টা জয়। টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড – সবই তিনবছরে এসেছে স্ক্যালোনির দখলে। এ বিশ্বকাপ লিওনেল মেসির আলোয় ঝলমলে। তবে ওই যে, আর্জেন্টিনার বহুকাঙ্ক্ষিত ট্রফিটি পেতে গেলে সেদিন মারাদোনার পাশে দরকার ছিল কার্লোস বিলার্দোকে, আর এখন মেসির দরকার লিওনেল স্ক্যালোনি আর তাঁর মগজাস্ত্রকেই।