বয়স একশো পেরিয়েছে। লিও মেসির প্রতিটা গোলের নাড়িনক্ষত্র তিনি লিখে রেখেছেন নিজের নোটবুকে। এমন ফ্যানের দেখা কি আর মিলবে! তাঁর খোঁজ পেয়ে উদ্বেল স্বয়ং লিও মেসি। নিজে তাঁকে পাঠালেন ভিডিওবার্তা। আর মেসির এই সৌজন্যেই অভিভূত বিশ্ব।
অনেকেই বলেছেন, ফুটবলের দেবতা এক শাপভ্রষ্ট দেবদূতকে অবশেষে দিয়েছেন তাঁর স্বপ্নপূরণের দিন। এতদিন কলঙ্ক নিয়ে ছিলেন, অবশেষে শাপমুক্তি। অনেকেই বলেন তিনি ফুটবলের শ্রেষ্ঠ জাদুকর। আর্জেন্টাইন এই জাদুকরের বাঁ পায়ের শিল্পে মোহিত গোটা বিশ্ব। তিনি লিওনেল মেসি।
মাত্র কদিন আগে এবছরের কোপা আমেরিকার খেতাব জয়ের পর লিওনেল মেসির স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। দেশের জার্সিতে অবশেষে এল কোনও খেতাব। দেখা গিয়েছিল, সেই আবেগঘন মুহূর্তে মাঠ থেকেই স্ত্রীকে ভিডিও কল করেছিলেন, দেখাচ্ছিলেন গলায় ঝোলানো মেডেলটি। আবার নেইমার তাঁকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললে, তাঁকে সান্ত্বনার কাঁধে দিচ্ছেন আশ্রয়। ফুটবলের যুবরাজের গোটা পৃথিবী জুড়েই অগুণতি ভক্ত। তেমনই এক ভক্ত স্পেনের বাসিন্দা ডন হার্নান। বয়স সবে একশ পেরিয়েছে। এমন তো কোনও অলিখিত নিয়ম নেই, ফুটবলের রাজপুত্রের আবেগী ভক্ত হতে গেলে তাঁকে কোনও বিশেষ বয়সের হতে হবে। আর বয়স তো একটা সংখ্যা মাত্র।
আরও শুনুন : Lionel Messi : শাপমুক্ত Football, স্বপ্নের ফেরিওয়ালার স্বপ্ন হল সত্যি…
মেসির কেরিয়ারের শুরু থেকেই তাঁর জাদুতে মুগ্ধ হার্নান। খেলা শুরু হলেই টিভির সামনে বসে পড়েন। মেসির খেলা দেখা তাঁর চাই-ই চাই। শুধু খেলা দেখে তিনি ক্ষান্ত হন না। আজ পর্যন্ত মেসি যত ম্যাচে যত গোল করেছেন, সবই হার্নান খাতায় লিখে রেখেছেন। শুধু গোলের সংখ্যা নয়; কোন স্টেডিয়াম, কত তারিখ, কোন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কত মিনিটে, কীভাবে গোল করেছেন, সবই তাঁর নোটবইয়ে নোট করে রেখেছেন ডন হার্নান। এত ডিটেইলে গোলের হাল হকিকত বর্ণনা বোধহয় উইকিপিডিয়া অবধি দিতে পারবে না। এই কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি ভরিয়ে তুলেছেন প্রায় সাতশ তিরিশটি নোটবুক। হার্নান তাঁর নাতি জুলিয়ান মাস্ত্রানগেলো-কে সবসময় মেসিকে অনুসরণ করতে বলেন। দাদুর এমন পাগলপারা ভালোবাসার সাক্ষী নাতিও। সেই দাদুকে সঙ্গ দেয়। দাদুর কথা সে লিখে পোস্ট করেছিল ইনস্টাগ্রামে।
কোপা জয়ের পর অবসর সময় কাটাচ্ছিলেন লিও। সেসময় হার্নানের ব্যাপারে জানতে পারেন তিনি। কীভাবে তাঁকে ধন্যবাদ জানাবেন, এই চিন্তা ঘুরছিল তাঁর মাথায়। তারকাদ্যুতির তীব্র ছটার মধ্যেও লিও মেসির মধ্যে রয়েছে এক আর্দ্র মানবিক হৃদয়। সবসময় তিনি ভক্তদের ভালোবাসা গ্রহণের জন্য দরাজ। প্রতিদানে তাঁদের ফিরিয়ে দেন, অপার কৃতজ্ঞতা, শুভেচ্ছা।
এই ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয় কী করে! শতায়ু ভক্তের জন্য তিনি তৈরি করেন একটি ভিডিওবার্তা। পাঠান তাঁকে।
সেই ভিডিওবার্তায় মেসি বলেছেন, ‘হার্নান তোমাকে শুভেচ্ছা। তোমার গল্প আমি জেনেছি। আমার গোলের সব তথ্য তুমি এইভাবে সংরক্ষণ করেছ, এটা ভেবেই আশ্চর্য মনে হচ্ছে! আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরতে চাই, তোমার এই অতুলনীয় কাজের জন্যেও তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
নাতির আনা মোবাইলে আচমকা মেসির চেহারা। তাঁর মুখে নিজের নাম! দেখে-শুনে বৃদ্ধ হার্নান প্রথমেই বুঝতেই পারেননি, ব্যাপারটা আদতে হচ্ছে কি! নিশ্চয় নাতি তাঁর সঙ্গে কোনও ভুয়ো ভিডিও দেখিয়ে রসিকতা করছেন। তাঁর কাজকর্মের কথা মেসির মতো অতবড় তারকার পক্ষে জানা সম্ভব নয়! তাহলে তিনি জানলেন কি করে! নাতি তাঁকে বুঝিয়ে বলেন, সেই দাদুর কীর্তিকলাপ নিয়ে লিখেছিল ইনস্টাগ্রামে, সেই সূত্রেই স্বয়ং মেসি এই ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন। সবটা শুনে বুঝে ধাতস্থ হতে খানিক সময় লেগেছিল শতায়ু হার্নানের। আবেগে থরোথরো হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আনন্দে বিস্ময়ে তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন। ভক্তের সঙ্গে ভগবানের আচমকা সাক্ষাতে যেমন হওয়ার কথা, ঠিক তেমনই। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি তাঁর ভগবান লিওকে বলেন, ‘আমি চিরকাল তোমার খেলা অনুসরণ করেছি, আগামীতেও করব, জীবনের শেষ পর্যন্ত তোমার সঙ্গে থাকব লিও’।
নাতির মোবাইল ফোনে দাদুর সঙ্গে লিওর কথোপকথন অন্য কেউ ক্যামেরায় ধরেছিলেন। আপাতত সেই ভিডিওর আবেগে ভাসছে গোটা বিশ্ব।
তিনি নিজেই যেমন রূপকথার জন্ম দেন, তেমনই তাঁর গোটা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ভক্তেরা তাঁদের ভগবানের জন্য দিন গুজরান করেন। কলঙ্কের ক্রুশ থেকে শাপমোচন হয়েছে সদ্য। কিন্তু তিনি তাঁর ভক্তদের অগোচরে শেখান, বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকো, দিনশেষে তোমার স্বপ্ন নিশ্চয় সত্যি হবে। হবেই। তিন সত্যি।
আবারও যেন সেই কথাটিই শোনালেন লিও মেসি।