যে লিগ চ্যাম্পিয়ন হল ইন্টার মিয়ামি, তার গোড়া থেকে তো মেসি অধিনায়ক ছিলেন না। সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ডিয়ান্ড্রে ইয়েডলিন। বেকহ্যাম যখন মেসিকে আনলেন, খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁকেই দেওয়া হল অধিনায়কের আসন। ডিয়ান্ড্রে ইয়েডলিন নিজেই মেসিকে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। সেই সম্মান ফিরিয়ে দিয়ে মেসি যেন সম্পর্কের বৃত্তটিকেই সম্পূর্ণ করলেন। আপাত অর্থে মনে হতে পারে, এ মেসির মহানুভবতার পরিচয়। বাস্তবিক তাই-ই, তবে তার বাইরেও আর একটা বার্তা থেকে যায়।
ভিনগ্রহের বাসিন্দা! তাঁর সম্পর্কে অনেকে এ-কথাই বলে থাকেন। যে অবিশ্বাস্য দক্ষতা, মেধা, পরিশ্রমে তিনি ফুটবলবিশ্বকে নিজের ইন্দ্রজালে বশ করে রাখেন, তাতে কেউ যদি তাঁকে অন্য গ্রহের ভাবেন, তবে দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু তিনি, লিওনেল মেসি, বারেবারে প্রমাণ করেন, তিনি এই গ্রহেরই একজন। এমন একজন মানুষ যিনি শুধু ফুটবল-মেধায় নয়, মানবিকতায় এই পৃথিবীটাকে আর-একটু সুন্দর করে তুলতে চান। এই যে ইন্টার মিয়ামিকে প্রথম ট্রফি জেতালেন, সারা বিশ্ব জানে, মেসি নামক অতিমানবিক প্রতিভা ছাড়া বেকহ্যামের দলের সে স্বপ্ন পূরণ হত না। যে লক্ষ্য নিয়ে, যে দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে পিএসজি থেকে আনা হয়েছিল, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন তিনি। প্রফেশনাল ফুটবলে এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত সাফল্যের ইতিবৃত্ত। কিন্তু তিনি, লিওনেল মেসি, আরো-একটু এগিয়ে ভাবতে ভালবাসেন। প্রতিযোগিতায় তিনি জিতেছেন বহুবার, অবিশ্বাস্য গোল করেছেন অসংখ্য। সে সব যেন তাঁর কাছে আর বড় কথা নয়। বরং প্রতিযোগিতার বাইরে এ পৃথিবীটা যে মানুষের, ফুটবলের থেকে মানুষে-মানুষে সম্পর্কের জোরেই যে নীল গ্রহখানা আজও জ্যান্ত হয়ে আছে, সে কথাখানাই যেন নিরুচ্চারে বলতে চান তিনি। অতএব জয়ের পর অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড পরিয়ে দিলেন মিয়ামির প্রাক্তন অধিনায়ক ডিয়ান্ড্রে ইয়েডলিনের হাতে। একসঙ্গেই স্পর্শ করলেন জয়ের স্মারক। আর পৃথিবী পেল আরও একটি মুহূর্ত, যেখানে প্রতিযোগিতা পেরিয়েও ফুটে ওঠে সম্পর্কের অপূর্ব সুন্দর আলো।
আরও শুনুন: ছোট্ট পনিটেল, হেডব্যান্ড আর উইম্বলডনের সেই রজার রাজার গল্প
আসলে মেসি নামের বিস্ময়টি যেন ফুটবলের অতীত। ব্যক্তিগত দক্ষতায় তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন বহুবার। সারা পৃথিবী জানে, মানুষটি দুরূহ কোণ থেকে, প্রায় অসম্ভব মুহূর্তেও বল জালে জড়িয়ে দিতে পারেন। এতটাই অবিশ্বাস্য সে দক্ষতা যে ফুটবল মাঠের আধুনিক হালচাল পর্যন্ত বদলে গিয়েছে তাঁর দৌলতে। কিন্তু এ সবই তো চেনা গল্পগাছা। মেসির নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই এরকম অযুত উদাহরণ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চলে আসে বহু গোলের স্মৃতি। তবে সেই গোলের ঝলমলে আলো পেরিয়েই পৌঁছতে হয় মেসির শান্ত সবিনয় জীবনদর্শনে। অর্জনের ঔদ্ধত্যে তা চোখ ধাঁধিয়ে দেয় না। বরং তা মানুষকে যেন পৌঁছে দেয় অপূর্ব এক উপশমের পরিসরে। যেখানে প্রতিযোগিতা পেরিয়ে, দৌড়ের কানাগলি অতিক্রম করেও মেলে দু-দণ্ডের শান্তি। আর তাই মেসি বলেই তিনি বলতে পারেন, আমি গোল করতে ভালবাসি ঠিকই; তবে সেই সঙ্গে আমি যাঁদের সঙ্গে খেলছি, তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতেও ভালবাসি। গোলের সংখ্যার পাশাপাশি বন্ধুর সংখ্যা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ যে আরও জরুরি, তা মেসি বলে দেন নির্দ্বিধায়। আর তাঁর কাজে বারংবার এসে পড়ে সেই দর্শনেরই ছায়াপাত।
আরও শুনুন: আবেগের ধারাপাত নয়, ধারালো ব্যক্তিত্বেই সত্যিকার অধিনায়ক সুনীল
যে লিগ চ্যাম্পিয়ন হল ইন্টার মিয়ামি, তার গোড়া থেকে তো তিনি অধিনায়ক ছিলেন না। সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ডিয়ান্ড্রে ইয়েডলিন। বেকহ্যাম যখন মেসিকে আনলেন, খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁকেই দেওয়া হল অধিনায়কের আসন। কিন্তু অধিনায়কের দায়িত্ব কি আর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়! অন্য অনেকের জন্য হলেও, মেসির জন্য তা নয়। আর তাই ট্রফি হাতে নেওয়ার আগে আর্ম-ব্যান্ড তিনি পরিয়ে দিলেন ইয়েডলিনের হাতেই। ডিয়ান্ড্রে ইয়েডলিন নিজেই মেসিকে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। সেই সম্মান ফিরিয়ে দিয়ে মেসি যেন সম্পর্কের বৃত্তটিকেই সম্পূর্ণ করলেন। আপাত অর্থে মনে হতে পারে, এ মেসির মহানুভবতার পরিচয়। বাস্তবিক তাই-ই, তবে তার বাইরেও আর একটা বার্তা থেকে যায়।
এমন এক পৃথিবীতে আমরা এখন এসে পৌঁছেছি যেখানে অন্যকে দমিয়ে রেখে নিজেকে সেরা প্রমাণ করাই যেন একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। প্রতিযোগিতার সাপলুডো মানুষকে জড়িয়ে ধরেছে অনেকখানি। অর্জন এবং আরও অর্জনের তাগিদে সম্পর্কের বৃত্তগুলো ক্রমশ ছোট হয়ে এসেছে। মানুষ ছেড়ে দিয়েছে মানুষের হাত। অতএব ছোট ছোট বৃত্তে সে বড় একাকী। আর সেই প্রতিযোগিতা-জর্জর অবসন্ন পৃথিবীতেই মেসি জেনে ঢেলে দিলেন নিরাময়ের জ্যোৎস্না। যেন বলে দিলেন, প্রতিযোগিতা জেতাই শেষ কথা নয়। বরং অন্যকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেওয়া, গুণীর কদর করা, সর্বোপরি মানুষ হিসাবে মানুষের পাশে থাকাই জীবনকে আর একটু সুন্দর করে তুলতে পারে। মেসির কাজের ভিতর দিয়ে যখন এই শান্ত কথাটি ছড়িয়ে পড়ে তখন যেন এই বিদ্বেষদুষ্ট পৃথিবী আমাদের কাছে আর-একটু বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। আর-একটু মমতায় তাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। শুধু গোল করা নয়, মেসি যেন বলে দেন তাঁর ‘গোল’ আরও সুদূর প্রসারিত।
একদা এক শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্মের বিজ্ঞাপনে হাতে যে আর্ম-ব্যান্ড পরেছিলেন, সেখানে লেখা ছিল ‘সবার জন্য শিক্ষা’। সে তো আলাদা বিজ্ঞাপন। আর এদিন মেসি নিজের হাতের আর্ম-ব্যান্ড খুলে ফেলে নিজেই যেন হয়ে উঠলেন ‘সবার জন্য শিক্ষা’- মানুষে-মানুষে সম্পর্কের পৃথিবীর মুগ্ধ এক বিজ্ঞাপন।