সম্প্রতি শুরু হয়েছে কমনওয়েলথ গেমস। ইতিমধ্যেই ভারতের ঝুলিতে এসেছে বেশ কয়েকটি পদক। কিন্তু যাঁদের হাত ধরে এই সাফল্য আসছে তাঁদের জীবনের গল্প, আমরা সেভাবে জানি কি? পদক জেতার উচ্ছাসে তাঁদের নিয়ে যতই মাতামাতি হোক না কেন, তাঁদের বাস্তব জীবন মোটেও বিলাসবহুল নয়। দীর্ঘ দিন সংগ্রাম করে নিজেদের সাফল্যের শিখরে নিয়ে গিয়েছেন এইসব ক্রীড়াবিদরা। শুনে নেব তাঁদেরই কথা।
কারও বাবা বিক্রি করেন পান, তো কেউ সারাদিন মাঠে চাষ করেন। তবু অদম্য জেদের বশে ছাড়েননি নিজের পছন্দের খেলা। দীর্ঘ দিনের অধ্যাবসায় আর পরিশ্রম যদিও বিফলে যায়নি। অলিম্পিক হোক বা কমনওয়েলথ- বিশ্বের দরবারে নিজেদের সেরার সেরা পারফরম্যান্সে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন এঁরা। আমাদের দেশে এমন ঘটনা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। ক্রিকেট বা এরকম গুটিকয় খেলা যেরকম আলো পায়, বাকি খেলাগুলি সেই তুলনায় যেন অনেকটাই অন্ধকারে থেকে যায়। তাই সেইসব খেলার সঙ্গে যুক্ত মানুষদেরও যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হয় নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য। যেমন করতে হয়েছিল সদ্য কমনওয়েলথ গেমসে ভারতকে স্বর্ণপদক এনে দেওয়া মীরা বাই চানুকে।
আরও শুনুন: জাতীয় ঐতিহ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া, এবার লিফটে চড়েই হবে ইলোরা ভ্রমণ
ভরত্তোলন বিভাগে ভারতের হয়ে চূড়ান্ত সাফল্য এনে দিয়েছেন এই মহিলা। মহিলা হয়েও ভরত্তোলনের মতো তুলনামূলক অপ্রচলিত খেলার সঙ্গে যুক্ত, তাই সাফল্যের পথ একেবারেই মসৃণ ছিলনা চানুর ক্ষেত্রে। ছয় ভাইবোনের সংসারে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠা। তবু অল্প বয়সেই ধরতে হয়েছিল সংসারের হাল। সরকারের বদান্যতায় চাকরি পেয়েছিলেন ভারতীয় রেল বিভাগে। সারাদিন চলে যেত সেই চাকরির পিছনেই। আলাদা করে অনুশীলনের সময় পেতেন না সেভাবে। কিন্তু মনের জেদ থাকলে সব বাধাই সহজে পার করে ফেলা যায়। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই আন্তর্জাতিক মঞ্চে জিতেছিলেন রুপোর পদক। তারপর ডাক পান রিও অলিম্পিকস-এ। কিন্তু সেখানে আশানুরূপ ফল করতে পারেননি মীরা। হতাশ হয়ে দেশে ফিরলেও থামেনি তাঁর লড়াই। দীর্ঘ ২০ বছরের খরা কাটিয়ে ২০১৭ সালে ভরত্তোলনে প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন। আর তারপর টোকিও অলিম্পিকে একেবারে সিলভার মেডেল। এখানেই শেষ নয়। সম্প্রতি বারমিংহাম কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জিতেছেন তিনি। তাই ভারতীয় মহিলাদের ভরত্তোলন বিভাগে তাঁর নাম যে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, একথা বলাই যায়।
এরপর ফিরে দেখা যাক পুরনো দিনের কয়েকজন অ্যাথলিটের দিকে। প্রথমেই বলতে হয় মিলখা সিং-এর কথা। বিখ্যাত এই দৌড়বিদকে সবাই ‘ফ্লাইং শিখ’ নামেই চিনতেন। একসময় পয়সার অভাবে ১০ কিমি রাস্তা খালি পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতেন মিলখা। তাঁর জন্ম হয় পাঞ্জাব প্রদেশের একটি গ্রামে যা দেশভাগের পর পাকিস্তানের অংশ। শৈশবেই সাক্ষী হয়েছিলেন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার। চোখের সামনে মৃত্যু হয়েছিল পরিবারের সদস্যদের। দেশভাগের সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা নিয়ে চলে আসেন নিজের বিবাহিত দিদির কাছে। সেখানেই অভাবের মাঝে বড় হয়ে মিলখা পরে যোগ দেন ভারতীয় সেনা বিভাগে। ছোট থেকে দৌড়তে পারতেন খুব জোরে। সেই সুবাদে ঠাঁই হয় আর্মি একাডেমিতে। দীর্ঘ অনুশীলনের পর ১৯৫৮ সালে অংশ নেন কমনওয়েলথ গেমসে। সেখানেই প্রথম দেশের জন্য নিয়ে আসেন সোনার পদক। এই ধারা অব্যাহত থাকে ৬২ সালের এশিয়ান গেমস-এও। তৎকালীন সময়ে ভারতের মতো দেশে দৌড়বিদ হয়ে এতটা সাফল্য সত্যিই এক নজিরবিহীন ঘটনা ছিল। পেয়েছিলেন পদ্মশ্রী-ও।
আরও শুনুন: মহিলা সরকারী কর্মীদের জন্য ঋতুকালীন ছুটির কথা ভাবছে না সরকার, জানালেন স্মৃতি ইরানি
একইসঙ্গে বলতে হয় মেরি কম-এর কথা। অল্পবয়সেই তিন সন্তানের মা হয়েছিলেন। সেই তিনিই গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন কোনই বাধাই পেরোনো অসম্ভব নয়। তিনিই বোধহয় ভারতে সর্বাধিক আলোচিত মহিলা বক্সার। ২০১২ সালে দেশকে প্রথম ব্রোঞ্জ এনে দিয়ে খবরের শিরনামে উঠে এসেছিলেন মেরি। প্রকাশ্যে এসেছিল তাঁর জীবন সংগ্রামের গল্প। একা হাতে তিন সন্তানকে লালন করা এবং সমান তালে বক্সিং চালিয়ে যাওয়া মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। তবু মেরি প্রায় হাসিমুখেই সামলেছেন সব। জয়ের ধারাও রেখেছেন অব্যাহত। টানা পাঁচ বার বিশ্বসেরা মহিলা বক্সার হওয়ার পাশাপাশি কমনওয়েলথ গেমসে জিতেছেন সোনা-ও। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র ক্রীড়াপ্রেমী নয়, প্রতিটা ক্ষেত্রেই দেশের মেয়েদের সাহস জুগিয়েছে মেরি কমের এই জীবন সংগ্রামের কাহিনি।
এরপর শোনা যাক দীপা কর্মকারের কথা। তাঁর গল্প বারে বারে মনে করিয়ে দেয় হাল না-ছাড়ার মন্ত্র। ত্রিপুরার আগরতলার বাসিন্দা দীপা কর্মকার প্রথম ভারতীয় মহিলা জিমন্যাস্ট হিসেবে অংশ নেন অলিম্পিকে। রিও অলিম্পিকসে তাঁর জিমন্যাস্টিক প্রদর্শনী-ই নাকি পেয়েছিল সেরার সেরা খেতাব। অল্পের জন্য পদক হাতছাড়া হলেও গোটা বিশ্ব তাকিয়ে দেখেছিল তাঁর অসাধারণ শৈলী। গোটা বিশ্বে মাত্র পাঁচজন জিমন্যাস্ট সফল ভাবে প্রদর্শন করতে পেরেছেন ‘ভল্ট অফ ডেথ’ নামের এক বিশেষ কায়দা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন দীপা। তবে পদক হাতছাড়া হলেও, হাল ছাড়েননি দীপা। কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে রেখে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন অন্য মঞ্চের জন্য। সাফল্য আসে ২০১৪-এর কমনওয়েলথে। দেশকে এনে দিয়েছিলেন ব্রোঞ্জ পদক। ভারতে মাটিতে দাঁড়িয়ে একজন জিমন্যাস্ট হিসেবে এমন মঞ্চে অংশ নেওয়াটাই বেশ বড় ব্যাপার। সেখানে দীপা অবলীলায় জিতেছেন পদক।
আরও শুনুন: মারা গিয়েছেন ৩০ বছর আগে, জমিয়ে বিয়ের আসর বসল সেই মৃতদের
তালিকায় যাঁর নাম না রাখলেই নয় তিনি হলেন সাইনা নেহওয়াল। ভারতীয় মহিলা ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার হিসেবে তিনিই প্রথম দেশকে এনে দিয়েছিলেন পদক। তাঁর জীবনের গল্পটাও বেশ অন্যরকম। মেয়ে বলে জন্মের পর সাইনার মুখ পর্যন্ত দেখেননি তাঁর ঠাকুমা। ছোট থেকেই অবহেলার মাঝে বড় হওয়া সাইনা পণ করেছিলেন, একদিন কিছু করে দেখাবেন। সেই জেদ আর চূড়ান্ত অধ্যাবসায়ের জেরে প্রমাণও করে দেন নিজের ক্ষমতা। প্রথমে অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ তারপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বের দরবারে উজ্জ্বল করেছেন দেশের নাম। কমনওয়েলথ গেমস-এ জিতেছেন সোনা, রুপো ও ব্রোঞ্জ তিনটিই। ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও পেয়েছেন বহু সম্মান।
এ তালিকা সংক্ষিপ্ত নয়। একের পর এক ক্রীড়াবিদদের জীবনের পাতা উলটে দেখলে উঠে আসে একইরকম অবহেলা আর বঞ্চনার ছবি। চূড়ান্ত দারিদ্রের মাঝে বড় হয়েও দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন এমন ক্রীড়াবিদের সংখ্যা ভারতে নিতান্ত কম নয়। পি টি ঊষা থেকে শুরু করে দীপিকা কুমারি কারও নামই বাদ দেওয়া যায় না। প্রত্যেকের জীবন সংগ্রামের কাহিনি প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করে আমাদের। অনুপ্রেরণা দেয় ভারতের প্রত্যেক ক্রীড়াপ্রেমীকে, যুবসমাজকে।