গলির ভিতর জীবন। জীবনের চোরাগলি। তার ভিতর ফুটবল খেলছে ছেলেটা। কেউ কেউ দেখছেন, সোনালি চুলের ছেলেটা প্রতিবন্ধকতার বারে ধাক্কা খাইয়েই সাফল্যের জালে জড়িয়ে দিচ্ছে চোরাগলির জীবনকে। ঝাঁ চকচকে ইউরোর রাজপথে ছড়িয়ে পড়ছে গলির অকৃত্রিম ঘ্রাণ। বাঙালি জানে লড়াইয়ের ঘাম মুছে জীবনের জিতে যাওয়ার এই আখ্যান, হলেও হতে পারে মতি নন্দীরই কোনও উপন্যাস। লামিন ইয়ামাল-এর সে আখ্যানে চোখ রাখলেন সরোজ দরবার।
ছেলেটার গল্প হলে হতেও পারত মতি নন্দীর কোনও উপন্যাস।
গলির ভিতর জীবন। জীবনের চোরাগলি। তার ভিতর ফুটবল খেলছে ছেলেটা। ভালোবাসে খেলাটাকে। কিন্তু ভালোবাসলেই কি খেলাটাকে আঁকড়ে ধরে একটা আস্ত জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়! ছেলেটার বাড়ির অবস্থা আহামরি কিছু নয়। সেই কবে দিদিমা চলে এসেছিলেন মরক্কো থেকে স্পেনে। দিদিমা খুব ভালোবাসতেন নাতিপুতিদের। ফুটবলপাগল ছেলেটাকেও। এখানে এসে এলাকার সরু গলিতে ঘুরে বেড়াত ছেলেটা। আশেপাশে জ্ঞাতিগুষ্টির বেকারি দোকান। জীবন আর লড়াইয়ের ঘ্রাণে বুক ভরে নিয়ে ছেলেটা নেমে পড়ত ছোট একটা মাঠে। যেখানে খেলতে গেলে পয়সা দিতে হত না। একদিন আকস্মিক জীবনে বিপর্যয়। মা-বাবার সম্পর্কের সুতো গেল ছিঁড়ে।
আরও শুনুন:
ফুটবল যেখানে ভালোবাসা, ফুটবল যেখানে দেশপ্রেম
ছেলেটার গল্প হলে হতেও পারত মতি নন্দীর উপন্যাস।
বিপর্যয় কিংবা শাপে বর! চেষ্টা করে ছেলেটার মা কাজ জুটিয়ে ফেললেন একটা ফুড চেনে। দুজনেরই জীবনে এলেন দিয়াজ নামে এক ভদ্রলোক। ফুটবলপাগল। লোকে ভালোবেসে কিংবা মশকরা করে বলে, লোকাল কুবালা। তা, জহুরি জহর চেনে। ছেলেটাকে ভর্তি করে দেওয়া হল স্থানীয় এক ক্লাবে। অল্পবিস্তর যা রোজগার হয় তাতে সংসারেরও সামান্য সুরাহা। স্থানীয় একটা লিগেই একদিন বল নিয়ে জীবনকে ড্রিবল করতে করতে এগোচ্ছিল ছেলেটা। একজন ঠায় দাঁড়িয়ে দেখলেন সেই স্কিল। তারপর ফোন করে কাকে যেন বললেন, আমার মনে হয় ছেলেটাকে এখুনি নেওয়া উচিত। লোকটা ছিলেন বার্সার স্কাউট।
মতি নন্দীর উপন্যাস হলেও হতে পারত ছেলেটার গল্প।
সরু গলির জীবন থেকে বার্সার রাজপথে। একেবারে রাজার পাশে। বার্সার রাজা ছেলেটাকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসেন। আগলে আগলে রাখেন। একদিন তো তর্কই উঠে গেল। এ কি ভালোবেসে আগলে রাখা, নাকি আগলানোর ছলে খেলতে না দিয়ে আটকে রাখা! তর্ক হয়তো বৃথাই। তবু কার সঙ্গে তুলনা চলছে! ছেলেটা বোঝে সবই। কেউ কেউ মৃদু বলাবলি শুরু করেছেন, বার্সার রাজার উত্তরাধিকারী চলে এসেছেন। ছেলেটার ছবি ততদিনে বসে গেছে সরু গলির জীবনের ছোট্ট দোকানের দরজায়। তার আত্মীয় জানে, ছেলেটা বার্সার হয়ে খেলতে নামলেই বেকারির বিক্রি বেড়ে যাবে। কিসমত! ছেলেটার গোটা পরিবার জানে, কিসমতের খেলা বড় আজব, অভূতপূর্ব, অভাবনীয়।
ফলত ছেলেটার গল্প হতেই পারত মতি নন্দীর উপন্যাস।
ইউরোর সেমি। বড় মঞ্চ। সমালোচকরা বলছেন, সব আছে ছেলেটার, নেই শুধু এত বড় মঞ্চে দাপিয়ে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা। সে কথা মাথায় রেখেই সোনালি চুলে হাত বুলিয়ে ছেলেটা নেমে পড়েছে মাঠে। সামনে দিদিয়ের দেশঁ-র ফ্রান্স। মাঠে বিশ্বকাপ কাঁপানো এমবাপে। এক দৌড়ে প্রতিপক্ষর দুর্গ ধসিয়ে দিতে পারেন যিনি। ছেলেটা এর মধ্যে কী করবে! ভাবতে না ভাবতেই গোল খেয়ে গেল নিজের দল। কোনওক্রমে সামলে নিয়ে ফরাসি দুর্গে আক্রমণ হানার চেষ্টা করছে স্প্যানিশ আর্মাডা। সেই সময়ই বক্সের কাছাকাছি বল পেয়ে গেল ছেলেটা। ডিফেন্ডাররা তৈরি। ছেলেটা শরীরের ঝোঁকে এক ডিফেন্ডারকে বোকা বানাল। তারপর চকিতে ভারসাম্যে ফিরে জায়গা নিয়ে নিল। এক লহমায় যেন তরবারির মতো ঝলসে উঠল তার বাঁ পা। আর বলটা যেন সেই শিল্পের সামনে নতজানু হয়েই বারে ধাক্কা খেয়ে ঢুকে গেল ফ্রান্সের জালে। ক্যামেরা দেখল, পিছনে তখন চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে এমবাপে। বিস্ময়ে দেখছেন তারকার জন্ম।
আরও শুনুন:
বিশ্বকাপ জিতে অশালীন উল্লাস, এবার জয়ের আনন্দ ফেলে ব্যর্থ বিপক্ষের কান্না মোছালেন সেই মার্টিনেজই
একটা ষোলো বছরের ছেলের সোলো শোয়ে ভেসে গেল বিশ্ব। কেউ দেখছেন বার্সার রাজা মেসির ঝলক। কেউ দেখছেন আগামী কয়েক দশকের বুনো ঘোড়াকে। আর কেউ কেউ দেখছেন, সোনালি চুলের ছেলেটা প্রতিবন্ধকতার বারে ধাক্কা খাইয়েই সাফল্যের জালে জড়িয়ে দিচ্ছে চোরাগলির জীবনকে। ঝাঁ চকচকে ইউরোর রাজপথে ছড়িয়ে পড়ছে গলির অকৃত্রিম ঘ্রাণ।
না, লামিন ইয়ামালের জীবনের গল্পটা মতি নন্দী লেখেননি। তবে বাঙালি জানে লড়াইয়ের ঘাম মুছে জীবনের জিতে যাওয়ার এই আখ্যান, হলেও হতে পারে মতি নন্দীরই কোনও উপন্যাস।