দেশকে যখন একযোগে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে তুলে দেন কোহলি-শামি, সেদিনও এই অস্বস্তিকর স্মৃতি খোঁচা দিয়ে যায় যে, শামিকে ধর্ম তুলে হেনস্তা করেছিলাম আমরা, এই ভারতবর্ষের মানুষই। আর তার প্রতিবাদ করায়, বিরাটের দুবছরের মেয়েকেও পেতে হয়েছিল ধর্ষণের হুমকি! বিশ্বকাপের এই দেশ যেমন আমাদের, বাকি সব কিছুও আমাদের স্বরচিত। বিশ্বকাপ ফুরোলে সেই অন্য দেশেই কি আবার ফিরে যাব আমরা? উত্তর খুঁজলেন সরোজ দরবার।
এই দেশটার ভিতর আছে আর একটা দেশ। হেঁটে দেখতে শিখুন। বিশ্বকাপ যখন তুলে ধরছে প্রায় অলৌকিক এক রূপকথার দেশকে, তখন শঙ্খবাবুর বিখ্যাত সেই পঙক্তির অনুকরণে এ কথাই যেন বলতে ইচ্ছে করে। এই তো সেই দেশ, যেখানে একযোগে রূপকথা লিখে চলেছেন বিরাট কোহলি, মহম্মদ শামি। এই দেশ গুণীর কদর করে, আদর করে, সম্মান দেয়, সম্ভ্রম করে, প্রশংসার বিশেষণে ভরিয়ে দেয় ভালোবাসার মানুষকে। এই দেশ সব ভুলে এক লক্ষ্যে, এক আবেগে কেঁপে উঠতে পারে। বিশ্বকাপের ম্যাজিক স্লেটে এই দেশকেই তো আমরা নিয়ত দেখতে পাচ্ছি। স্কোরবুকের দিকে তাকিয়ে দেখুন, এই দেশকেই সে তাই দশে দশ দিয়েছে। কলকাতার গঙ্গার পার হোক আর আরব সাগরের তীরের মুম্বই, এ দেশ মাঠের এগারোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠতে পারে, যে যেখানে লড়ে যায় আমাদেরই লড়া।
এই দেশ কাঙ্ক্ষিত, প্রার্থিত, এই দেশই থাকে স্বপ্নে।
আরও শুনুন: শুধু ধর্ম ধর্ম! তোমার ক্রিকেট নেই, ভারতবর্ষ!
তবু, এটুকুই তো দেশের সবটা নয়। এই যে শামির অবিশ্বাস্য কীর্তির আশেপাশে, না চাইতেও চলে আসছে তাঁর ধর্মপ্রসঙ্গ, এ-ও ঘোর বাস্তব। এই যে অনুষ্কার প্রতি উড়ে যাওয়া কোহলির সপ্রেম চুমু মনে করিয়ে দিচ্ছে, অনুষ্কার প্রতি ধেয়ে যাওয়া অতীতের ট্রোলিং, তার থেকে নিখাদ সত্যি তো আর কিছু হয় না। আজ মায়াবী রূপকথার দিনেও তাই ফিরে আসে সেই অস্বস্তিকর সত্যি যে, শামিকে ধর্ম তুলে হেনস্তা করেছিলাম আমরা, এই ভারতবর্ষের মানুষই। আর তার প্রতিবাদ করায়, বিরাটের দুবছরের মেয়েকেও পেতে হয়েছিল ধর্ষণের হুমকি!
এই দেশ প্রার্থিত নয়, স্বপ্নের নয়, তবু তিক্ত হলেও সত্যি।
আসলে দুটো দেশই সত্যি। দুটো দেশকেই সত্যি করে তুলেছি আমরা, দেশবাসীরাই। আজ তাই ক্রিকেট যখন তার উৎকর্ষে ঝলসে উঠছে, তখন চাপা থাকছে না এই অন্ধকারটুকুও। সাফল্যের আলো দিয়ে অন্ধকার মোছার চেষ্টা একরকমের দুর্ভাগ্যই। কেননা প্রতি মুহূর্তে সে দেশকে, দেশবাসীকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, এত কালো মেখেছি দুহাতে! আজ যেন আলো দিয়েও তা আর ধোয়া সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। কবে থেকে যেন সবকিছু ভুলে জীবনটাকে আমরা ধর্মের ছুরিতে বানরের পিঠে ভাগের গল্প করে তুলেছি। ফলে আমাদের না আছে ধর্ম, না আছে জিরাফ। যে চরকিপাকে আমরা ক্রমাগত পাক খেয়ে চলেছি, সেখানে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন আর মর্ম। রাজনীতির হাঁ-মুখ আমাদের ক্রমাগত গিলে ফেলতে চেয়েছে। আর তার সামনে আমাদের আত্মসমর্পণ দিন দিন প্রকট হয়ে উঠেছে। ফলাফল এই যে, এখন আমাদের হাতে আছে শূন্য। আলোর পথযাত্রী হতে গিয়েও আমরা দেখছি আমাদেরই সমস্ত দৈন্য, নীচতা জড়িয়ে আছে আমাদের সর্বাঙ্গে। দেশের ভিতর আমরা লালন করে চলেছি আর একটা দেশ, যা আমাদের স্বস্তি দেয় না এক মুহূর্ত।
আরও শুনুন: জন্মদিনের সেঞ্চুরি ঘটনা মাত্র! আসলে প্রতিটি সেঞ্চুরিই বিরাটের জন্মদিন
আমরা কি চাই এমনটাই চলুক? এই যে বিশ্বকাপের দেশ, তা তো তেমন কিছু বলছে না। হাতে হাত রেখে বেঁধে বেঁধে থাকার কামনাই তো ফুটে উঠছে সর্বজনীন এই ক্রিকেটব্রতে। তাহলে? আবার যখন নির্বাচন আসবে, আমরা কি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠব! কোনও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে জঙ্গি সাজিয়ে তবেই দেশভক্তির আত্মগৌরব অনুভব করব! আবার যখন দেশে দলিত নির্যাতন হবে আমরা কি দেখেও না দেখার ভান করে থাকব না! আবার কোনও শামির হেনস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কোনও কোহলির মেয়েকে ভয়াবহ হুমকি পেতে হবে না তো! আবার কোনও অনুষ্কাকে ট্রোল করার সময় আমাদের হাত কাঁপবে তো!
প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া সহজ নয়। কেননা সেই আত্মবিশ্বাস আজ আর আমাদের বুকে নেই। বিশ্বকাপের এই দেশ যেমন আমাদের, বাকি সব কিছুও আমাদের স্বরচিত। কোন পথে আমরা এগোব, কোন দেশকে আমরা বাঁচিয়ে রাখব সে সিদ্ধান্ত আমাদেরই।
বিশ্বকাপ একদিন ফুরিয়ে যাবে। তখন আমরা মনে রাখব তো যে, এই রূপকথা রচনা করেছিলেন কোহলি, শামি একযোগেই? এই দেশটা সকলেরই, এই ছোট্ট কথাটুকু সেদিনও আমরা জোর দিয়ে বলতে পারব তো! বিশ্বকাপের পরীক্ষা ফুরোলে সে পরীক্ষা শুরু আমাদের, ১৪২ কোটি ভারতবাসীরই।