অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ইউক্রেন যোগ্যতা অর্জন করেছে ইউরোর মূলপর্বে। রুশ সেনার আগ্রাসনে ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে ইউক্রেনের তাবড় স্টেডিয়াম। প্রতিযোগিতা দূর অস্ত, পর্যাপ্ত অনুশীলন সারতে পারেননি ফুটবলাররা। সেই বিপন্নতার মধ্যেও প্লেয়ার থেকে দেশবাসী– সবাইকে একসূত্রে বেঁধেছে ফুটবল। লিখছেন সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশ। প্রাণের কোলাহল থমকে গিয়েছে যেন আচমকাই। শহরের রাস্তায় সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক। আকাশে চক্কর দেয় যুদ্ধবিমান। কোথাও আবার বারুদের গন্ধে বাতাস ভারী। জনশূন্য অট্টালিকাগুলো খাঁ খাঁ করে। ধ্বংসলীলার এমন ক্ষতচিহ্ন ইউক্রেনের সারা শরীর জুড়ে। সেই মৃত্যুপুরীর দিকে তাকিয়ে কি চোখের কোণটা ভিজে আসে আন্দ্রে শেভচেঙ্কোর? জানা নেই। বারো বছর আগে, এমনই এক সময়ে তো ইউরো কাপকে ঘিরে মেতে উঠেছিল তাঁর দেশ। কিয়েভের বুকে সেদিন খুশির রোশনাই জ্বেলেছিলেন তিনি– শেভচেঙ্কো, ইউক্রেনিয়ান ফুটবলের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি।
সেদিনের কথা কি তাঁর আজ বড্ড বেশি করে মনে পড়ছে না? হয়তো পড়ছে, বড্ড বেশি করেই মনে পড়ছে, তিনি বলছেন না! ওই চোয়ালচাপা মুখের আড়ালে নির্বাসিত করেছেন সেই চেনা আবেগকে। যে আবেগ ঝরে পড়ত তাঁর গোলের পর। মিলান থেকে মাদ্রিদ, কিয়েভ থেকে লন্ডন– সর্বত্র। সেই শেভচেঙ্কো আজ কি করে হাসবেন? যে দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কালো মেঘে ঢাকা, ভিটেমাটি ছেড়ে ছিন্নমূল জীবনকে বেছে নিতে হয় দেশের সিংহভাগ মানুষকে, সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের ভূমিপুত্র হয়ে তাঁর মুখে কি আর হাসি মানায়! সে হোন না তিনি আন্দ্রে শেভচেঙ্কো।
আরও শুনুন: মাঠে এবং মাঠের বাইরে সুনীলই দেশের যথার্থ অধিনায়ক
২০১২ সালের ইউরো কাপ। সে এক খুশির দিন ছিল ইউক্রেনের। আয়োজক হিসেবে, জায়ান্ট-কিলার হিসেবে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মঞ্চ ছিল সেই ইউরো আসর। কে জানত, বছর বারো পর এমন অন্ধকারময় সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে দেশটাকে। যেখানে ফুটবলের উন্মাদনার বদলে জল্লাদের উল্লাস শোনা যাবে। শোনা যাবে, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনবাসীর কাতর-যন্ত্রণা। দু’বছরের নিয়ত সংগ্রাম কেড়ে নিয়েছে দেশটার সুখ-শান্তি-ভবিষ্যৎ। শুধু কাড়তে পারেনি ফুটবলকে ঘিরে জমাট বাঁধা ভালোবাসাকে। তাই বন্দুকের নলকে স্তব্ধ করে ইউক্রেন আজ ইউরো কাপে, শত প্রতিকূলতাকে জয় করে। কী বলবেন একে? স্রেফ ভালোবাসা?
একযুগ আগে ফুটবল ছিল ইউক্রেনের ভালোবাসা। আজ সেই ভালোবাসার অঙ্কুর থেকে জন্ম নিয়েছে দেশপ্রেম। তাই ভরা সাংবাদিক সম্মেলনে যখন ইউক্রেনের জাতীয় দলের কোচ সার্হেই রেবরভ বলেন, ‘আমার ছেলেরা সমর্থকদের জন্য মাঠে লড়াই করে, আমার ছেলেরা দেশের জন্য লড়াই করে, আমার ছেলেরা দেশবাসীর জন্য লড়াই করে’; তখন ইউক্রেনের লড়াই নিছক ফুটবল মাঠের পরিসীমায় বাঁধা থাকে না, ছড়িয়ে পড়ে দেশের মুক্তির সংগ্রামে। মিখাইলো মুডরিখ, আলেকজান্ডার জিনচেঙ্কোরা তখন কেবল ফুটবলার নন, এক-একজন দেশনায়ক হিসেবে জায়গা করে নেন ইউক্রেনবাসীর হৃদয়ে।
অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ইউক্রেন যোগ্যতা অর্জন করেছে ইউরোর মূলপর্বে। রুশ সেনার আগ্রাসনে ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে ইউক্রেনের তাবড় স্টেডিয়াম। প্রতিযোগিতা দূর অস্ত, পর্যাপ্ত অনুশীলন সারতে পারেননি ফুটবলাররা। সেই বিপন্নতার মধ্যেও প্লেয়ার থেকে দেশবাসী– সবাইকে একসূত্রে বেঁধেছে ফুটবল। তাই ইউরো কাপে যখন বাকি দেশগুলো প্লেয়ারদের নাম ঘোষণা করেছে, ইউক্রেন বেছে নিয়েছে ভিন্নপন্থা। ভূমিপুত্রদের নাম ঘোষণা করেছেন সে দেশের সাধারণ মানুষ। পেশায় কেউ ক্যাবচালক, কেউ দমকলকর্মী, কেউ শিক্ষক, কেউ ছাত্র, কেউ বা রেডিও-জকি, কেউ আবার প্রতিবন্ধী। তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, স্বজনহারানো শোকের মধ্যে ফুটবলই তাঁদের বাঁচার আশ্রয়, ফুটবলই তাঁদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন।
ইতিহাস সাক্ষী, যুদ্ধবাজের রক্তচক্ষুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অতীতেও এভাবেই নিজেদের আত্মমর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে ইউক্রেন। অবশ্য, সোভিয়েত তখনও ভেঙে যায়নি, ফলে আজকে যে রাশিয়ার সঙ্গে তার যুদ্ধ, ইউক্রেন তখন তারই অংশ ছিল বটে। তবে সেই সময়েও ইউক্রেন মারের মুখে দাঁড়িয়ে যে পালটা লড়াই ফিরিয়ে দিয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কুখ্যাত ‘ডেথ ম্যাচ’ তারই সাক্ষ্যবহন করছে। যেখানে মৃত্যুভয়কে নস্যাৎ করে ফুটবল মাঠে জয়ধ্বজা উড়িয়েছিল কিয়েভের কারখানার কিছু ফুটবল অন্তপ্রাণ দামাল ছেলে। নাৎসি বাহিনীর তরফে পরিষ্কার হুঁশিয়ারি ছিল– ‘জিতলে মরতে হবে!’ না, সেই হুমকির কাছে মাথা নুইয়ে যেচে হার স্বীকার করেননি আলেকজান্ডার তাচেঙ্কো, ইভান তুজমেঙ্কোরা। ম্যাচ জয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে সেই জয়ী দলের পাঁচ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে হিটলারের নাৎসি বাহিনী। বাকিদের ঠাঁই হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। আজকের জিনচেঙ্কো, লুনিনরা পূর্বজন্মে কি তুজমেঙ্কো, তাচেঙ্কো ছিলেন? কে জানে!