মনু ভাকেরের জয় থেকে দিকেচের ভাইরাল ছবি- অলিম্পিক্সের মরশুমে শুটিং নিয়ে চর্চা তুঙ্গে। আর এই আবহেই মনে করে নেওয়া যাক সেই শুটারকে। গুলি ছোড়ার ডান হাত উড়ে যাওয়ার পরও যিনি লড়াইয়ের ময়দান ছাড়েননি। সোনা জিতে নিয়েছিলেন অলিম্পিক্সের আসরেও। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তাঁর কথা।
একলব্যের গল্প জানি আমরা। যে হাতে তির ছোড়ার অমানুষিক ক্ষমতা ছিল, সেই হাতের বুড়ো আঙুল কেটে দিতে হয়েছিল দ্রোণকে। তাতেও হার মানেননি নিষাদ রাজার ছেলে। ফের অভ্যাস করেছিলেন বাঁ হাতে তির ছোড়া। ক্যারয় তোক্যাচ নিশ্চয়ই একলব্যের গল্প জানতেন না। তবে তাঁর লড়াইটাও ঠিক যেন একলব্যের মতোই। তফাত একটাই, বাঁ হাতের অস্ত্রচালনাকেও তিনি এমন দক্ষতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যাতে সেখানেও তাঁকে কেউ হারাতে না পারে। কোনও যুদ্ধেই যে হারতে শেখেননি এই শুটার।
:আরও শুনুন:
মনের দৈত্য যখন পথ রুখে দেয়, ‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্র শেখান সিমোন
সাম্প্রতিক অলিম্পিক আবহে শুটিং নিয়ে চর্চা তুঙ্গে। দেশে এখনও পর্যন্ত সবকটি পদকই এসেছে শুটিংয়ের হাত ধরে। এর মধ্যেই আবার নেটদুনিয়ায় ভাইরাল তুর্কি শুটার দিকেচের ছবি দেখে উদ্বেল আঠেরো থেকে আটষট্টির নারীহৃদয়। তাঁর অনায়াস ভঙ্গি নিয়েই কথা হচ্ছে আরও বেশি করে। আর সেই অনায়াস শুটিংয়ের প্রসঙ্গই মনে করিয়ে দিচ্ছে ক্যারয় তোক্যাচকে।
ক্যারয়ের জন্ম হাঙ্গেরিতে, ১৯১০ সালে। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই হাতে তুলে নিতে হয়েছিল আগ্নেয়াস্ত্র। দেখা গেল, দিনে দিনে পিস্তল শুটিংয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন তিনি। কোনও প্রতিযোগিতায় প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হওয়া যেন তাঁর নিয়মেই নেই। গোটা দেশ অপেক্ষার প্রহর গুনছিল, অলিম্পিক্সে নিশ্চয়ই হাঙ্গেরিকে সোনা এনে দেবেন ক্যারয়। ১৯৩৬ সালে অলিম্পিকের আসর বসে জার্মানির বার্লিনে। কিন্তু বার্লিনগামী হাঙ্গেরির দলে জায়গা হল না তাঁর। কেননা, অবসর না নিলে সেনাবাহিনীর কেউ নাকি শুটিংয়ে নাম দিতে পারবেন না। ছাব্বিশের তরতাজা তরুণ তখন সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট, নিয়মের চক্করে তাঁর অলিম্পিক্সে যাওয়া হল না। তবে ভাগ্য ভালো, এরপরই এই নিয়ম বাতিল করা হয়। মহোৎসাহে ‘৪০-এর অলিম্পিক্সের জন্য অনুশীলন শুরু করলেন ক্যারয়।
কিন্তু ভাগ্য আসলে অন্য গল্প লিখছিল। বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে প্রায়। এমন সময়েই, ১৯৩৮ সালে সেনাবাহিনীতে ট্রেনিং চলাকালীন একটা গ্রেনেড ফেটে গেল ক্যারয়ের হাতেই। প্রাণে বাঁচলেন বটে, তবে হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর দেখলেন, ডান হাতটা আর শরীরে নেই।
অলিম্পিক্সের স্বপ্ন, দেশকে পদক এনে দেওয়ার আশা, সব শেষ হয়ে গিয়েছিল সেই দিন। নিজেকে চার দেওয়ালে মধ্যে বন্দি করে গুমরে মরতেন ক্যারয়। ইচ্ছে করত মরে যেতে। সেইখান থেকেই একসময় ঘুরে দাঁড়ান ক্যারয়। ডান হাত গিয়েছে, আরেকটা হাত তো আছে। যদিও, বাঁ হাতে কোনও কাজ করতে হয়নি কখনও। তাও, চেষ্টা শুরু করলেন ক্যারয়।
চার-চারটে মাস। অক্লান্ত পরিশ্রম। দুর্ঘটনার ৬ মাস পর, হাঙ্গেরিতে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের আসরে এসে দাঁড়ালেন ক্যারয়। দেশের তাবড় তাবড় শুটারেরা হাজির সেখানে। ক্যারয় তাঁদের অনুপ্রাণিত করতে এসেছেন, এ আনন্দ তাঁরা কোথায় রাখবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। সেই সময়ই, ঠান্ডা গলায় ক্যারয় ঘোষণা করলেন, তিনি অনুপ্রেরণা দিতে আসেননি। এসেছেন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে।
সেই চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছিলেন ক্যারয় তোক্যাচ। বাঁ হাতে গুলি ছুড়েই। এরপরের লক্ষ্য চল্লিশের অলিম্পিক্স। ফের ভাগ্যের মার। ১৯৩৯ সালে শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। থমকে গেল অলিম্পিক্স। আরও চারটে বছরের অপেক্ষা! তবুও, ভাগ্যের পরিহাসকে যিনি ততদিনে জয়ে বদলে নিয়েছেন, তাঁকে ভয় দেখাবে আর কে!
:আরও শুনুন:
চুমুর দিব্যি! ঠোঁটে ঠোঁটের খেলাতেও নজর কাড়ে অলিম্পিক্স
১৯৩৬ সালে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্যারয়, তা পূরণ হল ১৯৪৮-এ এসে। অলিম্পিক্সের মঞ্চে পা রাখলেন ৩৮-এর ক্যারয়। খেলার দুনিয়ায় বয়স একটা বড় ফ্যাক্টর। তার উপর ডানহাতি শুটারের ডান হাতটাই নেই। গোটা দুনিয়া লোকটার সাহস দেখে অবাক। সেই অবাক চোখেই তারা দেখল, অন্তিম প্রতিযোগিতায় মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন তখনকার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভ্যালিয়েন্তে, আর ক্যারয়। শেষ রাউন্ডে বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে ছিটকে দিয়ে পোডিয়ামে উঠে দাঁড়ালেন সব্যসাচী ক্যারয়।
পরের বার, ১৯৫২-র হেলসিংকি অলিম্পিক্সেও শুটিং বক্সে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ক্যারয়। ফের সোনা এনে দিয়েছিলেন দেশকে। আর সব হারতে বসা মানুষদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, হেরেও জিতে যায় যে মানুষেরা, পৃথিবীর সব রূপকথা লেখা হয় তাদেরই জন্য।