খেলা মানে লড়াই। শত্রুকে গুঁড়িয়ে দেওয়া। খেলার সঙ্গে যুদ্ধের এমনই সমীকরণ টেনেছি আমরা। আর সেই শত্রুতার বয়ানে মুছে দিয়েছি খেলোয়াড়ি বেঁধে থাকার গল্পগুলো। তবুও খেলার মাঠ পাশে থাকার রূপকথা লেখে আজও। যেমনটা লেখা হল ভারত-নিউজিল্যান্ডের সেমিফাইনাল যুদ্ধে।
পাখির চোখ বিশ্বকাপ। তার লক্ষ্যেই মরিয়া দৌড় দুই দেশের। মাঠে খেলছে এগারোটা মানুষ, আর তাদের পিঠে এসে নিশ্বাস লাগছে গোটা দেশের সমস্ত মানুষের। যারা দেশকে ট্রফি হাতে দেখার প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে আছে ঠিক পিছনেই। এই বিপুল প্রত্যাশার চাপ বয়ে নিতে নিতেই দুটো দল নিজেদের সমস্তটা উজাড় করে দিচ্ছে এই কয়েক ঘণ্টায়। ওয়াংখেড়ের পরিবেশে টান ধরছে পেশিতে, তবু মাটিতে পড়ে যেতে যেতে উঠে দাঁড়াচ্ছে কেউ কেউ। কারণ, যুদ্ধের ময়দান ছাড়া যায় না। অথচ এই মার, পালটা মারের মধ্যেই হঠাৎ করে তৈরি হয় একেকটা মুহূর্ত। যখন ক্র্যাম্পের ব্যথায় ছটফট করতে থাকা বিরাটের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন কিউয়িরা। আবার ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ে ভারতকে যখন রীতিমতো চাপে ফেলে দিয়েছেন ডারিল মিচেল, ক্যাপ্টেন রোহিতের কপালে চিন্তার ভাঁজ, সেই সময়েই দেখা যায়, হঠাৎ ক্র্যাম্পের জেরে মাটিতে বসে পড়েছেন মিচেল। স্বাভাবিকভাবেই তখন আশেপাশে ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটারেরা। তাঁদের মধ্যেই ছিলেন ঈশান কিশান। যদিও সেমিতে ব্যাট হাতে নামার সুযোগ পাননি ওয়ানডে-তে ২০০ রান করা এই ব্যাটার। কিন্তু ফিল্ডিং-এর সময় নিজের দায়িত্ব পালন করা যে জরুরি, সে কথা তিনি ভোলেননি। আর সে দায়িত্বের মধ্যে কেবল নিজের দলের পাশে থাকাই যে পড়ে না, অন্য দলের পাশে থাকাও পড়তে পারে, সে কথা আরও একবার বুঝিয়ে দিলেন ঈশান। সোজা মিচেলের সামনে গিয়ে তাঁর পা ধরে স্ট্রেচিং করাতে শুরু করেন তিনি। আর এই সামান্য ছবিটাই যেন একঝটকায় পালটে দেয় ক্রিকেট মাঠ আর মাঠের বাইরেই হিংস্র লড়াইটাকে। যে লড়াইয়ে ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচকে আর কেউ খেলা বলে ভাবতেই পারে না। যেখানে বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যে লাগাতার কুকথার চাষ হয়। যে লড়াই এতটাই গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছে যে, বিরাটের ক্র্যাম্প ধরার সময় কিউয়িরা কেন সাহায্য করেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন করতে বাধে না অজি ক্রিকেটারের। যে লড়াই ভুলিয়েই দিয়েছে, আসলে যে কোনও খেলারই একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষকে জুড়ে থাকতে শেখানোর কথা ছিল। এই নিষ্ঠুরতার দুনিয়াতেই একেক দিন আলতো বৃষ্টির মতো করে নেমে আসে এহেন বন্ধুত্বের ছবি। যা আমাদের খানিক থমকে দেয় এই ইঁদুরদৌড়ের ময়দানেও।
আরও শুনুন: কোহলি-শামি একসঙ্গেই লেখেন দেশের রূপকথা, বিশ্বকাপ ফুরোলে দেশবাসী মনে রাখবে তো?
ক্রিকেটপ্রেমীরা ভোলেননি, আগের বিশ্বকাপে কেন উইলিয়ামসনের নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরেই বিদায় নিতে হয়েছিল ভারতকে। এবারের সেমি তাই হয়তো ছিল সেবারের হারের বদলা নেওয়ার সুযোগ। কিন্তু এই ম্যাচ সম্পর্কে সেই নিষ্ঠুর বিশেষণ আর প্রয়োগ করাই যায় না বোধহয়। কী করেই বা যাবে! এ কথা ঠিক যে, কিউয়ি বোলারদের বলে বলে মাঠের বাইরে ফেলেছেন রোহিত-বিরাট-শ্রেয়সরা। আবার রানের পাহাড় তাড়া করেও কেন উইলিয়ামসন আর ডারিল মিচেল একসময় রোহিত ব্রিগেডকে প্রায় তছনছ করে ফেলছিলেন। কিন্তু সেই উইলিয়ামসন-রা বিরাট কোহলির সেঞ্চুরির পরে প্রায় প্রত্যেকে এসে হাত মিলিয়ে যান। মনে পড়ে, ২০১৯-এর বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে হারের পর তৎকালীন অধিনায়ক বিরাট কোহলিকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন এই কেন উইলিয়ামসন-ই। যে ফ্রেমটা এবার তৈরি হল ফের। বুড়ো আঙুলে চোট থাকা উইলিয়ামসনের হার না-মানা ব্যাটিংয়ের পরও যখন হারতে হল নিউজিল্যান্ডকে, তাঁকে জড়িয়ে নিলেন কোহলি। আর এই টুকরো টুকরো ফ্রেমের কোলাজেই বিরাট-ঈশানরা মনে করিয়ে দিলেন, আসলে যুদ্ধ নয়, ভালোবাসারই অন্য নাম ক্রিকেট।