তাঁরা বারেবারে নিজেদের প্রমাণ করেছেন। টুকটাক তাঁদের নিয়ে মাতামাতিও হয়েছে। কিন্তু এটুকুই কি সব! যে দেশে ক্রিকেট নাকি ধর্ম, সেখানে যত স্বপ্ন সব ধোনি-কোহলিদের জন্যই তোলা? মিতালি, ঝুলনরা আর কতবার নিজেদের প্রমাণ করে বোঝাবেন যে, মহিলা ক্রিকেট নিয়ে আমাদের এবার সত্যিই নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। সেই প্রশ্নই তুললেন, সুলয়া সিংহ।
‘ওমেন আর দ্য রিয়েল আর্কিটেক্টস অফ সোসাইটি।’ অর্থাৎ, মহিলারাই সমাজের আসল স্থপতি বিখ্যাত মার্কিন লেখিকা হ্যারিয়েট বিচার স্টো বহু যুগ আগে একথা বললেও পিতৃতান্ত্রিক সমাজে তা কোথায় যেন ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। তবে তাঁর সে উপলব্ধি যে নেহাত কল্পনা ছিল না, বর্তমান হয়তো তারই প্রমাণ দিচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজেদের মেলে ধরছেন মহিলারা। জানান দিচ্ছেন তাঁদের অস্তিত্ব আর গুরুত্ব। ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট যার অন্যতম বড় দৃষ্টান্ত।
একটা সময় চুপিসারেই একের পর এক সিরিজ খেলেছেন অঞ্জু জৈন, ঝুলন গোস্বামী, অঞ্জুম চোপড়ারা। নদীর স্রোতের মতোই কত টুর্নামেন্ট এসে নিঃশব্দে চলে গিয়েছে, কেউ খেয়ালই করেনি। সেখানে আজ হরমনপ্রীত কৌর, শেফালি ভর্মাদের নামটুকুর সঙ্গে অন্তত পরিচিত ঘটেছে তথাকথিত ক্রিকেটপ্রেমীদের। বছরে এক-আধবার হলেও চায়ের ঠেকের আলোচনায় কোহলি-রোহিতদের সঙ্গে অন্তত মহিলা ক্রিকেটের কথাও উঠে আসছে। টপ অর্ডারের এমন পারফরম্যান্সই বা খারাপ বলা যায় কীভাবে!
খবরের কাগজের শেষ পাতাটায় জায়গা করে নিতে তাঁরাও তো কম পরিশ্রম করেন না। ২০১৭ বিশ্বকাপে যেমন দলকে ফাইনালে পৌঁছে দিয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন মিতালি। মহিলা ক্রিকেট নিয়ে সেই সময় বেশ হইহই পড়ে গিয়েছিল। আবার সেই মাতামাতি ফেরে গত বছর, যখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠল দল। স্মৃতি মন্দানাদের প্রশংসা করে ‘মহিলা ক্রিকেটের উত্থান’ ট্রেন্ডে গা ভাসিয়েছিলেন দর্শক। গুগলির জালে ব্যাটসম্যানকে ফাঁসানো পুনম যাদব কিংবা ব্যাট হাতে ফুলঝুরি জ্বালানো ১৬ বছরের শেফালি ভর্মা যেন ঘুমিয়ে পড়া মহিলা ক্রিকেটকে প্রোটিন সেক খাইয়ে দিয়েছিল। আগের তুলনায় ভিউয়ারশিপও বেড়ে গিয়েছিল ৩৯ শতাংশ। আবার কেরিয়ারের সায়াহ্নে ব়্যাঙ্কিং শীর্ষে পৌঁছে নতুন করে অবাক করছেন মিতালি রাজ।
কিন্তু এই মাতামাতিটুকুই কি যথেষ্ট? এতেই কি হাল ফিরবে মহিলা ক্রিকেটের? ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কেউ কি আকৃষ্ট হবে ব্যাট-প্যাড হাতে তুলে নিতে?
আসলে গাছ ভরতি ফলমূল পেতে হলে গোড়ায় জল দেওয়াটাও যে বড্ড জরুরি। ভারতবর্ষে ক্রিকেটকে বসানো হয় ধর্মের আসনে। ৯৩ শতাংশ দেশবাসী বাইশ গজের লড়াইয়ে আসক্ত। কিন্তু বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা কিংবা মহেন্দ্র সিং ধোনিদের সঙ্গে কি তাঁরা সমান তালে মিতালি, দীপ্তিদের খেলাও উপভোগ করেন? উত্তর সকলের জানা। না। কোথায় মহিলা ক্রিকেট আর কোথায় টিম ইন্ডিয়া! সত্যিই তো, কোহলিদের মতো তো ‘বিক্রি’ করা হয় না মিতালিদের। আচ্ছা, হরমনপ্রীতকে কোন বিজ্ঞাপনে দেখে যায় চট করে বলুন তো! না মনে পড়ারই কথা। কন্যা ভ্রূণহত্যার আখড়া হরিয়ানার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সামাজিক ট্যাবু ভেঙে উঠে এসেছেন শেফালি। তাঁকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য কী কী করেছে বিশ্বের ধনীতম ক্রিকেট বোর্ড? তার চেয়ে হয়তো অনেক বেশি করা হয় ঋষভ পন্থের জন্য। এবার বলবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। যে গাছ ফল দেয়, তার কদরই তো বেশি হবে। শচীন-সৌরভ-শেহওয়াগ-ধোনি-কোহলিদের সৌজন্যেই তো আজ ক্রিকেট বিশ্বের বেতাজ বাদশা বিসিসিআই।
কিন্তু শেফালিরাও কি পারে না? কেন তাঁদের পরিকাঠামোর উন্নতির কথা কেন ভাবা হয় না? কেন অনিল কুম্বলে কিংবা গ্যারি কার্স্টেনের মতো কোচ পাবেন না মিতালিরা? কেন ‘এ’ গ্রেড ক্রিকেটার হয়েও তাঁরা আটকে থাকবেন ৫০ লক্ষ টাকার গণ্ডিতে! যেখানে ‘এ প্লাস’ কোহলিরা এক বছরে নিয়ে যাবেন ৭ কোটি টাকা! কেন আগামীদের শচীন-ধোনি হওয়ার সঙ্গে মিতালি কিংবা ঝুলন হওয়ার স্বপ্ন দেখানো হবে না? কেন একটা আইপিএল কিংবা টেস্টের বিশ্বকাপের কথা ভাবা যাবে না তাঁদের জন্যও? তাহলে আর ধনীতম বোর্ড হয়ে লাভ কী? মেয়েদের ক্রিকেট খেলায় উৎসাহ দেওয়াও তো মহিলা ক্রিকেটের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ারই অংশ। তেমনটা হয় কি? চোখে তো পড়ে না। তাই তো ধুমকেতুর মতো মাঝেমধ্যে মিতালিরা মানুষের মনের মধ্যে এসে আলোড়ন সৃষ্টি করেন, আবার হারিয়েও যান। পুনম-শেফালি-শিখা পাণ্ডেদের কদর করার সত্যিই এবার সময় এসেছে। গিয়ার চেপে সঠিক পথে গাড়ি এগিয়ে গিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এবার নিতেই হবে বিসিসিআইকে।
তবেই তো আকাশে ওড়ার ইতিহাস রেখে যেতে পারবেন সমাজের এই রিয়েল আর্কিটেক্টরা।