ময়দানের তিন প্রধানের ইতিহাস এবার সিলেবাসে। পড়ুয়ারা জানবে, বাংলার ফুটবলের সোনালি অতীতের কথা। তবে, শুধু ফুটবল কেন, তা তো বাংলারই নিজস্ব ইতিহাস। এই সিদ্ধান্ত তাই বাঙালিকে ফিরিয়ে দিতে পারে তার ফুটবলের কাছেই। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
লিওনেল মেসি বা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর দুরন্ত গোলের খবরাখবর এই প্রজন্মের বাঙালির প্রায় কণ্ঠস্থ। গুগল করারও দরকার নেই। স্মৃতি হাতড়েই রীতিমতো সাল-তারিখ ধরে ধরে তাঁরা বলে দিতে পারেন, বার্সা, রিয়াল, চেলসির সাফল্যের বা ব্যর্থতার দিনক্ষণ? তবে, তাঁরা কি সেভাবে চেনেন চুনী গোস্বামী বা পিকে ব্যানার্জিকে? জানেন তাঁদের খেলার ইতিহাস? নামে হয়তো চেনেন। তবে, ঠিক যেভাবে আধুনিক ক্লাব ফুটবলের ইতিহাস চোখের সামনে ভাসে, সেরকম দৃশ্যের জন্ম হয় না।
অথচ এমন এক দিন ছিল, যখন এই ইতিহাসের টুকরোই সম্বল আর সম্পদ হিসাবে বুকের গভীরে বাঁধিয়ে রাখত বাঙালি। আমাদের মনে পড়বে কবীর সুমনের সেই বিখ্যাত গানের পঙক্তি- ‘মান্না-পিকে-চুনির ছবি বিরাট সম্বল’। বাঙালি ফুটবল ভালোবাসত শুধু নয়, ফুটবল তার সাংস্কৃতিক পরিচয়পত্রও বটে। বাঙালির কান্না-হাসির দোলদোলানো দিনে ফুটবল ছিল চিরকালের সঙ্গী। কবীর সুমনের স্মৃতিচারণেই আর একবার ফিরে যাওয়া যাক, “ছোটবেলায় কী একটা সিনেমা দেখতে গিয়ে, নিউজ রিলে দেখেছিলাম আফগানিস্থান বনাম ভারতের ফুটবল ম্যাচ। সেই ম্যাচে একটাই গোল হয়েছিল। সেই একটিমাত্র গোল করেছিলেন আমাদের চুনী গোস্বামী। বোধহয় সেটা, প্রি-অলিম্পিকস বা কিছু। এমনই পাগল ছিলাম আমরা, যে, সরস্বতী পুজোর ফুল-পাতা যেরকম বইয়ের মধ্যে রাখা হত, আমরা রাখতাম চুনী গোস্বামীর ছবি। খবরের কাগজ থেকে কেটে, পড়ার বইয়ের মধ্যে রেখে দিতাম তাঁর ছবি। বিশেষ করে, অঙ্ক বইয়ের মধ্যেই, কারণ অঙ্কে ফেল করতাম। আমাদের পাড়ায়, ইস্টবেঙ্গলের যাঁরা সাপোর্টার ছিলেন, চুনীর প্রতি তাঁদের রাগ ছিল প্রবল। কেন? ওঁরা বলতেন, চুনী পূর্ববঙ্গীয়। তাতে কিছু আসে-যায় না। আমি পশ্চিমবঙ্গীয়। আমি বুঝেছিলাম, চুনী গোস্বামী মানেই মোহনবাগান, আর মোহনবাগান মানেই চুনী গোস্বামী।” পিকে-র কোচিং, শ্যাম থাপার বাইসাইকেল কিক- এসব তো নেহাত একখানা ম্যাচের গল্প নয়। বাঙালির অন্তরে জেগে থাকা সময়ের অক্ষয় স্ট্যাম্প।
খেলোয়াড়দের মতোই ক্লাব নিয়েও যুযুধান শিবির। মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল নিয়ে বাঙালির যেমন দ্বন্দ্ব, তেমনই শ্লাঘা। কাউকে ছাড়া কারও চলে না। দলবদল নিয়ে কত না কিস্সা! কৃষাণু দে-র ম্যাজিকে মন্ত্রমুগ্ধ একটা গোটা প্রজন্ম। বাবলু আর মনোরঞ্জনের দ্বৈরথ তো প্রায় কিংবদন্তি। ডার্বি ম্যাচ ঘিরে তর্ক-বিতর্ক, ইলিশ আর চিংড়িতে ভাগ হয়ে যাওয়া। পাড়ায়, মোড়ে, বাজারে চায়ের দোকানে জোর তর্ক। এমনকী ভাইয়ে-ভাইয়ে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়েছে। এই সব গল্পগাছার মধ্যেই আছে বাঙালির যৌথতার ইতিহাস। শরিকি ভাগ, বিবাদ সত্ত্বেও যে একটা মেলামেশার সংস্কৃতি ছিল তার প্রমাণ দেয় ফুটবল। পাড়ার জোট পরোয়া করত না রাজনীতিকেও। সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনায় এই ছোট ছোট ঘটনার গুরুত্ব অমূল্য।
-: আরও শুনুন :-
ময়দান আর বাঙালির ইতিহাসকে তাই আলাদা করা যায় না। সেই পরম্পরা থেকে বাঙালি কি সরে গিয়েছে? একেবারে হয়তো নয়; তবে আগেকার উন্মাদনার আঁচ যে ফিকে হয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। ফুটবল নিয়ে বাঙালি এখনও পাগল। তবে, ডার্বি ঘিরে যে উচ্ছ্বাসটুকু চোখে পড়ে, বাকি সময় তা আর বজায় থাকে কই! এর নানা কারণ কাছে। একদিকে দেশের ফুটবলে সাফল্য কমে এসেছে। অন্যদিকে ক্লাব ফুটবলেরও বহু বিবর্তন হয়েছে। পুরনো লিগ বা টুর্নামেন্টের বদলে নতুন ধাঁচের টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছে। ফলত ক্লাব ও ফুটবলের প্রতি যে একাত্মভাব আগে ছিল, ইদানীং যেন সেই স্রোতে ভাটা। বরং প্রযুক্তির যুগে তরুণদের মন কেড়ে নিয়েছে আন্তর্জাতিক ফুটবল। শুধু বিশ্বকাপে আর তা সীমাবদ্ধ নেই। ভিনদেশি ক্লাবে ক্লাবেও ভাগ হয়ে গিয়েছে বাঙালির ফুটবলপ্রেম।
বাঙালি যে খুব ইতিহাসনিষ্ঠ এমনটা বলা যায় না। তবে একেবারে ইতিহাসবিমুখও নয়। বরং ঐতিহ্যের কদর করার প্রবণতাই বেশি। মান্না-পিকে-চুনিকে হয়তো এই প্রজন্মও ভুলতে চায় না। তবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যে সেই পরম্পরা বাহিত হবে, তার একটি সাধারণ কাঠামো থাকা উচিত। ফুটবল দিয়ে শুধু বাঙালির খেলার ইতিহাসকে নয়, সামগ্রিক ভাবেই একটা নির্দিষ্ট সময়ের বাঙালি ও বাংলার চরিত্র বোঝা যায়। আর তাই উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাসে শহরের তিন প্রধান ক্লাবের ইতিহাস পড়ানোর সিদ্ধান্ত আদতে এক সাধু পদক্ষেপ। তিন প্রধানের সোনালি ইতিহাসের কথা পড়ানো হবে। অবশ্য শুধু যে ক্লাস ঘরে বইয়ের পাতায় এই শিক্ষা সীমাবদ্ধ থাকবে, এমন নয়। পাশাপাশি একাদশ ও দ্বাদশের পড়ুয়ারা এই বিষয়ে প্রকল্প তৈরির জন্যও বেছে নিতে পারবে এই তিন ক্লাবকে। অর্থাৎ ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান বা মহামেডানের উত্থানের ইতিহাস নিয়ে হাতে-কলমে কাজ করার সুযোগও থাকছে পড়ুয়াদের কাছে। তিন প্রধানের কর্মকর্তারাও এই প্রস্তাবে খুশি। বাংলার ফুটবল ইতিহাস যদি বাঙালির নতুন প্রজন্মের কাছে উঠে আসে, তার থেকে ভালো আর কিছু হয় না! বর্তমানে তরুণদের মধ্যে বাংলার ক্লাব ফুটবল নিয়ে যে উৎসাহের ভাটা দেখা যায়, তা হয়তো ফিরবে ক্রমে ক্রমে।
সময় যতই বদলে যাক না কেন, ফুটবল ছাড়া বাঙালিকে সত্যিই ভাবা যায় না। ফুটবলের ইতিহাসের সূত্রে বাঙালি যদি আবার সময়ের আয়নায় মুখ দেখে, তবে লাভ তো এই বঙ্গেরই।