ভারতবর্ষে ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক কোনওকালেই খুব দূরের নয়। তবে, তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। যে, রাজনীতির যোগ থাকলেও, ক্রিকেটের মাঠে সেই রাজনৈতিক প্রদর্শন কতখানি বাঞ্ছনীয়? চব্বিশের নির্বাচনী আবহে ক্রিকেট নিয়ে যে রাজনীতি হতে পারে, এ সম্ভাবনা কারও কাছেই অজানা ছিল না। কিন্তু যে রাজনীতি হল, তাতে শুধু রাজনীতিবিদরাই নয়, অংশ নিলেন অসংখ্য সাধারণ মানুষই। কীভাবে? সেই উত্তরই খুঁজে দেখলেন সরোজ দরবার।
জিতলে কী হত কল্পনা করা মুশকিল; তবে, ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতের হারে ভারতীয় রাজনীতির তেমন লোকসান হয়নি। গণ-আবেগের হাটে বিকিকিনি বেশ ভালোই। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হচ্ছে বলে খানিক আপশোস হয়তো থেকে যেতে পারত। তবে খেলা ফুরোতেই বাইরের ‘খেলা’ যেভাবে শুরু হল এবং চলতে থাকল তো চলতেই থাকল, তাতে ক্ষতি আর কোথায়! বরং রোহিতরা যে লাভের কড়ি রাজনীতির হাতে তুলে দিতে পারেননি, মাঠের বাইরে যাঁরা ছিলেন তাঁরাই জোগালেন শেষ পারানির কড়ি। অতএব, সবার উপরে রাজনীতির হাসিই চওড়া হবে; খেয়াল করলে দেখা যায়, তা হয়েওছে।
আরও শুনুন: পোশাক নিয়ে খোঁচা থেকে ধর্ষণের হুমকি! জেন্টলম্যান’স গেমের বদলে কি লড়াইয়েই পালটে গেল ক্রিকেট?
ক্রিকেটের সূত্রে রাজনৈতিক ফায়দা প্রত্যাশা করছে বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দল। এবারের বিশ্বকাপ জুড়ে ছিল এই অভিযোগ। এমনিতে, ভারতবর্ষে ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক কোনওকালেই খুব দূরের নয়। ফলত, নতুন করে যদি রাজনৈতিক সখ্যের অভিযোগ আনা হয়, তা তেমন পোক্ত হবে না। তবে, তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। যে, রাজনীতির যোগ থাকলেও, ক্রিকেটের মাঠে সেই রাজনৈতিক প্রদর্শন কতখানি বাঞ্ছনীয়? তা কি শালীনতা অতিক্রম করে উৎকটও হতে পারে! এই যদি প্রশ্ন হয়, তবে বলতে হয়, সে-উত্তর সকলেরই জানা। বর্তমানে দেশের শাসনভার যে রাজনৈতিক দলের উপর ন্যস্ত, সে-দল যেভাবে রাজনৈতিক দৃশ্য রচনা করে মানুষের আবেগের সঙ্গে সেগুলোকে জুড়ে দিতে পারে, তার জুড়ি মেলা ভার। তা উচিত কি অনুচিত, এই নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন উঠতে পারে। ওঠেও। আর সেই প্রশ্নোত্তরের ভিতর দিয়েই মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে তাদের উপরিতল থেকে সংগঠিত করে বিভাজিত করার কাজটিও সারা হয়ে যায়। প্রতিটি প্রশ্নের ভিত্তিতে, জনতা দু-ভাগে ভাগ হয়ে যায়। চাপান-উতোর চলে, বিদ্বেষ বাড়ে। মানুষের থেকে দূরে সরে যায় মানুষ। ক্রিকেটের কাজ ছিল ঠিক উলটোটাই। জাতি-ধর্ম-মত নির্বিশেষে তা জনতাকে নিয়ে আসত এক লাইন-লেংথে। মাঠের এগারোজনের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষের তখন একটাই ‘পয়েন্ট’, একটাই ‘কভার’; এযাবৎ তাই-ই হয়েছে। ভারতে আবার ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা খানিক বেশিই। তাতে রাজনীতি আর বাণিজ্যের দুনিয়া একযোগে ইন্ধন জুগিয়েছে। ফলত কপিলের বীরগাথা, সুনীলের কবিতা কিংবা শচীনের ধ্রুপদিয়ানার ব্যাকরণ নিয়ে যত না আলোচনা, শিল্প নিয়ে যত না তারিফ, তার থেকেও বেশি মাতামাতি হার আর জয় দিয়ে। মাঠে জিতলে জনতা ক্রিকেটারদেরই জনার্দন করে তোলেন; অন্যথায় কুশপুতুল পোড়াতেও পিছপা হন না। দুই ক্ষেত্রেই আবেগের এই মাত্রাছাড়া প্রকাশ বেশ বিপজ্জনক। তবু এই ছবিটা যেন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। তেইশের বিশ্বকাপ এর ধারবার মাড়াল না। সোজা পৌঁছে গেল রাজনীতিতে।
আরও শুনুন: শুধু ধর্ম ধর্ম! তোমার ক্রিকেট নেই, ভারতবর্ষ!
ভারতের হারের পর, সম্ভাব্য অনেক কারণ হিসাবে যা উঠে এল, তা হল জাতীয় আবেগের পাহাড়প্রমাণ চাপ। তা কি অস্বাভাবিক ছিল! ভারতের মতো দেশে ক্রিকেটের যে কী চরিত্র তা ডেভিড ওয়ার্নার, ম্যাক্সওয়েলরাও দিব্যি জানেন। আর বিরাট-রোহিতরা জানেন না? সুনীল গাভাসকর তো বলেইছিলেন, স্নায়ু নিয়ন্ত্রণ করে যে-দল চাপ সামলাতে জানবে, ট্রফি তাদেরই। এই চাপ যেমন ক্রিকেটের, তেমন বাইরেরও। ভারত সেই স্নায়ুর যুদ্ধেই হেরে গিয়েছে। তবে, ততক্ষণে বাইরের জনতা হারের কারণ ঠিক করে ফেলেছে। সরাসরি দোষারোপ ছুটে গেল, স্টেডিয়াম নির্বাচনের দিকে। স্টেডিয়ামের নামকরণের দিকে। তারপর মাঠে প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতির দিকে। তারও পরে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিমান প্রদর্শনী, খেলার মাঝে অনুষ্ঠান ইত্যাদির প্রতি। এই অভিযোগ অযৌক্তিক? হয়তো নয়। তবে, এর কোনোটিই তো আকস্মিক নয়। বর্তমানের অভিযোগমুখর ভারতবর্ষ এসব আগে থেকেই জানত। ভারত জিতে গেলে, এসবের প্রতি দৃষ্টিপাতও হয়তো হত না। হেরে যাওয়ার দরুন খুলে গিয়েছে প্যান্ডোরার বাক্স। প্রশ্ন হল, সব অভিযোগের যদি যৌক্তিকতা ও সারবত্তা থেকেই থাকে, তাহলে তা নিয়ে আগে বাদ-প্রতিবাদ কোনওটিই বা হয়নি কেন! অভিযোগকারীরাও কি তাহলে জয়-পরাজয় দিয়েই ন্যায়-অন্যায়ের জল মাপছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই বোঝা যায়, কেন বারবার জিতে যায় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী জনমোহিনী রাজনীতির প্রবণতা।
চব্বিশের নির্বাচনী আবহে ক্রিকেট নিয়ে যে রাজনীতি হতে পারে, এ সম্ভাবনা কারও কাছেই অজানা ছিল না। যে রাজনীতি হল, তাতে শুধু রাজনীতিবিদরাই নয়, অংশ নিলেন অসংখ্য সাধারণ মানুষই। প্রতিবার প্রতি ইস্যুতেই এই ফাঁদটি পাতা থাকে। ক্রিকেটের সূত্রে যা হল এবং হচ্ছে তা সেই পরম্পরায় সাম্প্রতিক সংযোজন। বিরোধী দলের কেউ কেউ, রাজনীতির প্রশ্নেই প্রধানমন্ত্রীকে বিঁধেছেন। কেন তিনি মণিপুরে যাওয়ার সময় পেলেন না, অথচ খেলা দেখতে গিয়েছেন ইত্যাদি। সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ব্যক্তি আক্রমণ যত বাড়ল, তত উলটোদিক থেকে ছড়িয়ে গেল শামিকে বুকে জড়িয়ে ধরে তাঁর সান্ত্বনা দেওয়ার ছবি। রোহিত-বিরাটের হাত ধরে আবার এগিয়ে যাওয়ার ছবি। এই দলাদলিতে ক্রিকেট গেল অস্ট্রেলিয়ার পারে। খেলা শেষ হওয়ার পর সমস্ত খেলাটাই মূলত জড়ো হল প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তাঁর পক্ষ বনাম বিপক্ষের এই লড়াইয়ে বারবার লাভবান হয়েছেন তিনিই। যে রাজনীতি হওয়ার কথা ছিল, তা ক্রিকেটের কারণেই হয়ে উঠতে পারল না বলে আপাত দাবি করা হচ্ছিল; আবার এই যে রাজনীতি হতে পারত এবং হল না- এই বয়ান এত উল্লাসে ছড়ানো হল যে তাতে বাম হাতে পুজোর কাজটি অন্তত সমাধা হল। আর তা সম্ভব করে তুললেন হয়তো তাঁরাই, যাঁরা জোর গলায় জানাতে চাইছিলেন যে, ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতির প্রদর্শন তাঁরা চান না। রাজনীতি যদি হয়েই থাকে তা সকলের হাত ধরেই হল, তাতে কে যে কোন ভূমিকা পালন করলেন তা যেন জেনেও জানতে পারলেন না।
এসবই কিন্তু হল আমাদের চোখের সামনে। আমরা দেখছি, তবে এই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। নাকি চাইছি না? ব্রেশ্ট্-এর সেই বিখ্যাত কবিতার কথা মনে করা যেতে পারে। নির্বাণ কী, কী তার প্রকৃতি ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তরে বুদ্ধ জানিয়েছিলেন, এ প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। পরে শুনিয়েছিলেন জ্বলন্ত বাড়ির গল্প। ঘরে আগুন লেগেছে। ভিতরের লোক পুড়ছে। বাইরে থেকে যখন বলা হল যে, বেরিয়ে এসো, তখন ভিতরের লোক প্রশ্ন করল যে, বাইরের পরিবেশ এখন কেমন? হাওয়া দিচ্ছে না বৃষ্টি পড়ছে? ঘর জ্বলছে দেখেও যে তা ছেড়ে যেতে তৈরি নয়, তাকে আর বলার কিছু নেই। ব্রেশ্ট্ এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন, পুঁজির বোমারু বিমানবাহিনীর প্রসঙ্গ। তা দেখেও যারা চিন্তা করে, বিপ্লবের পর টাকাপয়সা আর ছুটির দিনের পোশাকগুলোর কী হবে, তাদের আর কী বলার থাকতে পারে! একই কথা এখানেও। যাঁরা ‘রাজনীতি চাই না’ বলেও রাজনীতির ফাঁদে পা দিয়ে ক্রিকেটকে হারিয়ে দিতে সহায়তা করলেন, তাঁদের কিছু বলার নেই। কেননা তাঁরা পুড়তেই চাইছেন, ফলত বারবার একই ফাঁদে পা দিচ্ছেন।
বলার শুধু এই যে, আমাদেরই দোষে ব্যাটারদের কান্না, সমর্থকদের কষ্ট– সবই হয়ে উঠছে রাজনীতির পুঁজি। এই রাজনীতি আমাদের বাইরে রেখে হচ্ছে না। তবু আমরা প্রশ্ন করতে পারলাম না যে, কপিল দেবের বিশ্বকাপ ফাইনালে আমন্ত্রণ না পাওয়ার ঘটনায় কি সংসদ মুলতুবি হতে পারে? ক্রিকেট নিয়ে এতই যখন রাজনীতির ঘটা, তখন এমনটাও কি কোনওদিন হওয়া সম্ভব!