নাইটদের নিজস্ব বাজিগর আছেন; তবে হেরে মন জেতা নয়, জিতেই মন জেতার বাজিগর যদি কেউ হন, তবে তিনি গৌতম গম্ভীরই।
সুনীল নারিন নাকি ক্রিস গেইল হয়ে গিয়েছেন। একটা সিজন আগেই মনে হচ্ছিল তিনি বোধহয় ফুরিয়ে গিয়েছেন। ব্যাট হাতে নিলে যেরকম আলো ছড়িয়ে পড়ত মাঠে, তা আর দেখা যাবে না। গোধূলির মৃদু আলোর নারিনকে যেন মেনে নিতে পারছিলেন না কেকেআর-এর অতিবড় সমর্থকও। সে দিন পালটে গিয়েছে রাতারাতি। তবে ম্যাজিকে নয়, নেপথ্যে আছেন একজন মানুষ। তিনি গৌতম গম্ভীর।
আরও শুনুন: ‘পরাগ’রেণু আপনি জাগে আইপিএল-এ! নাকি নেপথ্যে সেই ঘরোয়া ক্রিকেটে?
গম্ভীরকে নিয়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের আবেগের বিস্ফোরণ ঠিক ততখানি নয়, যতখানি তাঁর সমসাময়িক অন্য ক্রিকেটারদের নিয়ে। ভদ্রলোক আদতে একটু ঠোঁটকাটা প্রকৃতির। জাতীয় দল হোক বা কোনও বিশেষ ক্রিকেটারকে নিয়ে তাঁর যা মনে হয়, তা বলতে দ্বিধা করেন না। ফলে তা নিয়ে তর্ক-সমালোচনাও হতে থাকে। তবে, সেসবের মধ্যে যা অস্বীকার করা যায় না, তা হল, তাঁর ক্রিকেট-মস্তিষ্ক। নিখুঁত পরিকল্পনা এবং ম্যাচ রিড করার দারুণ ক্ষমতা। চোয়াল চাপা জেদে যেমন লড়াই করতে পারেন, তেমন ঝুঁকি নিতেও ভালোবাসেন। বিশ্বকাপ ফাইনালে তাঁর ৯৭ রানের ইনিংসটির কথা কেইবা ভুলতে পেরেছেন! একটুর জন্য সেঞ্চুরি হাতছাড়া হয়। নইলে হয়তো গম্ভীরের জন্য অন্য মঙ্গলকাব্য লেখা হয়ে যেতে এতদিনে। তবে সেদিনের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি কিন্তু বলেছিলেন যে, তিনি আপ্রাণ চাইছিলেন গম্ভীরের সেঞ্চুরিটা হোক। ক্রিকেট আকস্মিকের খেলা। অপ্রত্যাশিতের চমক থাকে বলেই তা রোমাঞ্চকর। তবে অনস্বীকার্য যে, সেদিনের ভারতের জয়ের রাস্তাটা তৈরি করে দিয়েছিলেন গম্ভীরই। শুধু স্কোরবোর্ডে রান যোগ করে নয়, লড়াইয়ের সাহস তিনি চারিয়ে দিয়েছিলেন গোটা দলের মধ্যে।
আরও শুনুন: রোহিত-বিদায়ে উল্লাসের জেরে মার, মৃত্যু ব্যক্তির… ক্রিকেট কি অসহিষ্ণু করে তুলছে ফ্যানদের?
সেই সাহসের পরিচয় অতীতেও পেয়েছে আইপিএল। কেকেআর-এর সঙ্গে তাঁর যেন নাড়ির সম্পর্ক। নাইটদের জৌলুসে কোনোদিন কমতি ছিল না। খরা ছিল ট্রফির। সে অভাব পূরণ করেন গম্ভীরই। নিজের খেলা ও দলের নেতৃত্ব দুই-ই সামলেছিলেন অসামান্য ভারসাম্যে। কেকেআর-এর সমর্থকরা তাঁদের নেতা হিসাবে প্রথমেই যাঁর কথা ভাবতে ভালোবাসেন, তিনি গম্ভীর। মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, যেমনটা হয়ে থাকে। তবে, চলতি সিজনে ফিরে এসেই পুরনো দলকে আবার চেনা ছন্দে ফিরিয়ে এনেছেন গম্ভীর। লড়াই, ঝুঁকি আর ক্রিকেটের যুক্তি-বুদ্ধিতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে নাইটদের ভোলই পালটে দিয়েছেন বলা চলে। তাঁর সবথেকে বড় সিদ্ধান্ত বোধহয় নারিনের মতো পিঞ্চ হিটারকে ওপেনারের জায়গায় ফিরিয়ে আনা। নারিন তাঁর ভরসার মূল্য রেখেছেন। আসলে, একজন মেন্টর আর খেলোয়াড়ের মধ্যে পারস্পরিক ভরসা আর নির্ভরতার জায়গা না থাকলে এই ধরনের পারফরম্যান্স বেরিয়ে আসে না। গম্ভীর জানতেন, নারিন এখনও কী করতে পারেন; নারিন জানতেন, গম্ভীর তাঁর উপর কেন ভরসা রেখেছেন, আর কী চাইছেন; বিশ্বাসের এই যুগলবন্দির ফলাফল দেখছে চলতি আইপিএল-এ। একই রকম অবাক করা সিদ্ধান্ত হল, অঙ্গকৃষ রঘুবংশিকে তিন নম্বরে তুলে আনা। টিম ম্যানেজমেন্টের সেই ভরসা যে বিফল যায়নি, তা জানে স্কোরবোর্ড আর বিপক্ষ। গম্ভীরের সবথেকে বড় কৃতিত্ব বোধহয়, নাইটদের মধ্যে আবার ট্রফি জয়ের খিদে জাগিয়ে তোলা। ফিরিয়ে আনা লড়াইয়ে এবং যুদ্ধে। ফলত ইতিহাস গড়ে পরপর তিন ম্যাচ জিতেছে তারা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বলাবলি শুরু হয়েছে যে, কেকেআর-এ গৌতম গম্ভীর যুগ শুরু হয়েছে। আইপিএল লম্বা জার্নি। শেষ পর্যন্ত কী হবে, বা হতে পারে, তা সময়ের হাতেই তোলা। তবে যেটা লক্ষ্যণীয় তা হল, কুড়ি-বিশের খেলা পরিচালনায় গম্ভীরের দক্ষতা। মাঠের বাইরে বসেই তিনি ম্যাজিক দেখাচ্ছেন। এই ফর্ম্যাটের খেলা এবং খেলোয়াড় নিয়ে তাঁর নিজস্ব কিছু দর্শন আছে। দেশের ক্রিকেটের স্বার্থে তা অতীতে বলেওছেন। সেভাবে অবশ্য তা গ্রাহ্য হয়নি। তবে তাঁর দর্শন যে ভুয়ো নয়, কেকেআর-এর দায়িত্ব নিয়ে যেন সেই কথাই প্রমাণ করে দিচ্ছেন গম্ভীর! পথ দেখানোর কাজ তিনি করছেন। চলতি মরশুমের সাফল্যের খতিয়ান বলছে, দেশের ক্রিকেট সে-পথ অনুসরণ করলে জয় বই হারানোর কিছু নেই।
নাইটদের নিজস্ব বাজিগর আছেন; তবে হেরে মন জেতা নয়, জিতেই মন জেতার বাজিগর যদি কেউ হন, তবে তিনি গৌতম গম্ভীরই।