বিশ্বকাপের মরশুম যেন কল্পলোক। পাড়ায় পাড়ায় মুছে গিয়েছে ভেদাভেদের স্থানীয় সংবাদ। বদলে জেগে আছে দূর মুলুকের জন্য ভালবাসা আর কেঁদে ফেলার গল্পগুলো। সেই গল্পই শোনালেন অর্পণ গুপ্ত।
পলেস্তারা খসা দেওয়ালে জোলো চুনকাম লেপে দেওয়া পাড়ায় পাড়ায় বহুদিনের রেওয়াজ। আসলে সেই সব মলিন দেওয়ালে ইটের এবড়ো-খেবড়োর উপর ওই স্যাঁতসেতে সাদা চুনে, কমলা-লাল কিংবা সবুজ দিয়ে ভোটচিহ্ন এঁকে দেওয়া রংমিস্ত্রিরাও জানেন, সব বিভেদচিহ্ন একদিন ঢাকা পড়ে যাবে বিরাট বিরাট ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-জার্মানির পতাকায়। এই সব পাড়ারা নীল গোলকের একেবারে বিপরীত গোলার্ধে থাকা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার জনপদ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। অথচ লিওনেল মেসির বাঁ পায়ের গোলার মতো গ্রাউন্ডার শট মিমো ওচোয়াকে ডিঙিয়ে এসে পড়ে এই পাড়াতেই। মাঝরাতের শীতে চাদর মুড়িয়ে থাকা জনতার সমস্বর চিৎকারে ভেঙে যায় জড়তার ডিফেন্স। আমরা, একসঙ্গে কুড়িয়ে আনি বলখানা।
আরও শুনুন: তরুণী সাংবাদিককে দেখে হারিয়েছিলেন মনোসংযোগ, তাঁকেই মন দিয়েছিলেন তারকা
এমনটাই তো হয়, কতবার যে হয়েছে! কুড়ি বছর আগেও, টাইটানের একটা ভুলে ফসকানো বল, দাঁত উঁচু হলদে জার্সির কোনও রোনাল্ডো নাজারিও বাজপাখির ক্ষিপ্রতায় জড়িয়ে দিলেন জালে। কাফু-রোনাল্ডো-রিভাল্ডো-ক্লেবারসনেরা ঝলমলে ব্রাজিল বিশ্বকাপ নিয়ে শুধু তো সাওপাওলোতে ফেরেননি, ফিরেছিলেন আমাদের নিজস্ব পাড়াতেও। চুলের ছাঁটে ব্রাজিল, হাঁটার কায়দায় ব্রাজিল, পিচবোর্ড বিশ্বকাপ ট্রফির বিস্ময়ে ব্রাজিল; আরও কত ব্রাজিল একটু একটু করে গজিয়ে উঠল রোমারিও-বেবেতো জমানার পর। মাস তিনেক আগে গুজরাট অশান্তির পর, কাঠের বেঞ্চিতে বসে গোধরা নিয়ে কলার চেপে ধরা দুই বন্ধুকে দেখেছি একসঙ্গে সেলুনে গিয়ে রোনাল্ডো হয়ে বেরিয়ে আসতে। এই বিরাট সাদা দড়ি থেকে ঝুলে পড়ে হলুদ-সবুজ-নীল-সাদা; আমাদের ক্রিকেট, আমাদের শচীন, আমাদের ইডেন-কোটলা-ভারত-পাকের আলুথালু আবেগের উপর যে জাতীয়তাবাদের বোঝা, ফুটবল বিশ্বকাপের সমর্থন-পাগলামি তার চেয়ে বহু দূরে। কিছুদিন আগে, বোলসেনারো ক্ষমতায় থাকাকালীন এক বন্ধুকে বলতে শুনেছিলাম, ‘লোকটা না গেলে আর ব্রাজিলের জন্য গলা ফাটাব না…’; বোলসেনারো ক্ষমতায় নেই। গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে কত জল বয়ে গিয়েছে। তবু, একথা নিশ্চিত যে, ও ব্রাজিলকে সমর্থন না-করে পারত না। রিচার্লিসনের গোল সাতসমুদ্র পেরিয়ে বুকে ঠিক বিঁধতই!
আরও শুনুন: অদ্ভুত চুলের ছাঁটে বাজিমাত, কেন এমন স্টাইল বেছে নিয়েছিলেন রোনাল্ডো?
ইউটোপিয়া। কল্পলোক। ফুটবল বিশ্বকাপের একটা মাস, তিরিশটা দিন, আসলে ছাদের মতো। ‘ধর্ম বা রাজনীতি, ঠাকুরের ছবি থেকে হরিবোল খই’-এর ভ্যাপসা জীবনের ঢাল বেয়ে আমরা ওই ক-দিন উঠে আসি ছাদে। নিজেদের আরও মেলে ধরি আকাশের সামনে। পাশাপাশি অনেকে। জেতা-হারা, ভাল-মন্দ, মজা-মশকরা, আচমকা রেগে যাওয়ার ককটেলে এ যেন কার্নিভাল। সাজো সাজো পাড়াগুলো, ভাড়া করা টিভিগুলো, মাঝরাতে গোল হলে দুমদাম শব্দে ফাটতে থাকা কালীপুজোর মিয়োনো পটকারা কীভাবে দেখে আমাদের? যদি এরা চরিত্র হয়ে চেয়ে থাকে, তবে দেখবে বিভেদের মাংসের টুকরো নিয়ে কাড়াকাড়ি করা, দেখা হলে এড়িয়ে যাওয়া জনতা কেমন লেপে লেপে আছে উৎসবের আলোয়। ক্রিকেটে তাও জাতীয়তাবাদের ভার আছে; কিন্তু সোনালি বুট পরা জিদান কোমরের দুলুনিতে ব্রাজিলের তারকাখচিত দলটাকে এলোমেলো করে দিলে মনখারাপ হয়ে যায় কেমন! কিছু নতুন ছেলেছোকরা কিনে আনে টাকমাথা মহানায়কের পোস্টার। বাকিরা ফিরে যায় টিভি বন্ধ করে। ইউরোপের ক্লাব ফুটবল না-দেখা, ফুটবল না-বোঝা জনতাও কেমন যেন পাশাপাশি এসে বসে। এক আগুনে হাত সেঁকলে যে আরাম লাগে। অথচ, ভাবলে অবাক লাগে, এ আগুন জ্বালল কে? বিলিতি খেলা বিশ্বের এত এত দেশে এমন বারুদের মতো ছড়াল তার নিজস্ব ধর্মে, কিন্তু ভারত? ফিফা র্যাংকিং-এ প্রথম একশোর কাছে না থাকা একটা দেশ কেমন ইরেজার দিয়ে মুছে দিচ্ছে দেশের সীমানা। গোল পৃথিবী তখন চৌকো ময়দান। তুলির আঁচড়ে কোন ব্যথা, কোন মুহূর্ত যে কোথায় গেঁথে যায়, তার যেন হিসাব মেলে না!
আরও শুনুন: ছিল না নাগরিকত্ব, মার্কিন দলের হয়ে গোল করে জাতীয় বীরের তকমা এই তারকার
মেসি জিতে গেলেন। ব্রাজিলও এগোচ্ছে। জার্মানি ফিরবে ঠিক। ফ্রান্সও দৌড়োচ্ছে। গলির মোড়ে দুটো পতাকা পাশাপাশি ঝুলে আছে, তার নীচে আরেকটু পর এসে বসবে দুই বন্ধু, আরও লোক আসবে, ম্যাচ শুরুর আগে এসে যাবে সব্বাই। পঞ্চাশ বছর ধরে কত কত মানুষ এসে বসে খেলা দেখে গেলেন এই শামিয়ানার মতো হয়ে থাকা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-জার্মানি-ফ্রান্স-স্পেনের পতাকার তলায়। কেমন অন্যরকম লাগে এই অলিগলিদের; বিশ্বকাপ এলে, অদৃশ্য দেওয়াল লিখনে স্কোরবোর্ড নেই, এই শীতের রাত, বিশ্বকাপের ক-টা দিন, আদতে বিরাট জীবনের একটুকরো সময়খণ্ড যেন। কী জাদু তার অস্তিত্বে, তার বিশালতায়! এইসব পাড়ায় এসে পড়ে তার আলো, ছায়া দিয়ে আঁকা হয় কল্পলোক, যার পাশে লেখা আছে- হামিন অস্ত, হামিন অস্ত, হামিন অস্ত…