ক্রিকেটে ধর্মীয় বিভাজনের কোনও জায়গা নেই। সাফ জানিয়ে দিলেন বিরাট কোহলি। এ শুধু তাঁর সহ-খেলোয়াড় মহম্মদ শামির পাশে দাঁড়ানোই নয়, বরং এই প্রজন্মের রোল মডেলের এই বার্তা গোটা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির নিরিখেই তাৎপর্যপূর্ণ।
ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা। কথাটা ক্লিশে হলেও সত্যি। বিভিন্ন সময় ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে নানা বিতর্ক দেখা গেলেও, কেউ না কেউ এসে দাঁড়ান, যিনি ক্রিকেটকে সবরকম কালিমামুক্ত করেন। সেরকমই একজন বিরাট কোহলি। একটা ম্যাচকে কেন্দ্র করে যখন সহ-খেলোয়াড় ধর্মীয় বিদ্বেষের শিকার তখন ক্যাপ্টেন হয়ে তিনি মুখ বুজে বসে থাকলেন না। এগিয়ে এলেন। দলের সদস্যকে আগলে রাখলেন। আর দিলেন কড়া বার্তা। সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন, ধর্মের কারণে কাউকে আক্রমণ করা নিকৃষ্ট, জঘন্যতম কাজ। ক্যাপ্টেনের এই বিবৃতি যে বিরাট গুরুত্বের দাবি রাখে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর তাই অধিনায়কোচিত এই পদক্ষেপের জন্য ক্যাপ্টেন কোহলিকে কুর্নিশ জানালেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের সেলেবরা। সে তালিকায় আছেন ফারহান আখতার, স্বরা ভাস্কর প্রমুখ।
আরও শুনুন: ২০২১-এ কেন ফিরল ১৫২৬! কেন ব্যঙ্গ শুধু শামিকেই!… এ দোজখনামা-য় মেলে না উত্তর
ঘটনাত সূত্রপাত বিশ-বিশের বিশ্বকাপে ভারত বনাম পাকিস্তান ম্যাচকে ঘিরে। এমনিতেই ভারত-পাক ম্যাচ মানে উত্তেজনা থাকে তুঙ্গে। তার উপর সেদিনের ম্যাচে পাকিস্তান যেরকম একতরফা আধিপত্য দেখিয়ে ম্যাচ জিতে নিয়েছিল, তাতে ভারতীয় সমর্থকরা বেজায় ক্ষুব্ধ হবেন, সে কথা সহজেই অনুমান করা যায়। তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়েছেনও বটে। কিন্তু গোল বাধল অন্য জায়গায়। সামগ্রিক দলের ব্যর্থতা হঠাৎ করে গিয়ে পড়ল একজন খেলোয়াড়ের উপর। সমর্থকদের কটূক্তি বর্ষণ সবটাই ওই একজন – মহম্মদ শামিকে লক্ষ্য করে। উপমহাদেশীয় ক্রিকেটের এ যেন এক অভিশাপ। এপারে ভারত-পাক ম্যাচ হারলে হেনস্তার শিকার হতে হয় শামিকে। ওপারে একইরকম সমালোচনার মুখে পড়েন সৌম্য সরকার। কিন্তু এই কি কাঙ্ক্ষিত! অন্য যে কোনও খেলার মতোই, ক্রিকেটও তো ধর্ম-বর্ণ-জাতির ঊর্ধে উঠে অন্যতর এক ভূমিকেই প্রতিষ্ঠা দেয়। খেলার মাঠের ছোট-বড় হারজিত যেন মানবিকতার গায়ে না লাগে, এমনটাই তো হওয়া উচিত। কিন্তু সামগ্রিক ভাবেই এই ভূখণ্ডের চরিত্রে অসহিষ্ণুতা যেভাবে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে, তাতে শামি বা শামির মতো আরও কাউকে কাউকে এহেন হেনস্তার মুখে বারবারই পড়তে হচ্ছে। ঘটনার পর প্রত্যাশিত ভাবেই প্রাক্তন ক্রিকেটররা শামির পাশে দাঁড়ান। তা সত্ত্বেও একটা শূন্যস্থান যেন থেকেই গিয়েছিল। ঠিক সেই জায়গায় বুক চিতিয়ে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন কোহলি। ম্যাচে বিপর্যয়ের সামনে যেমন প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে দুর্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, মাঠের বাইরের এই অসহিষ্ণুতাকেও কভার ড্রাইভে পাঠিয়ে দিলেন বাউন্ডারির ওপারে। সাফ সাফ জানালেন, ধর্মের ভিত্তিতে যাঁরা কাউকে আক্রমণ করেন, তাঁরা নিকৃষ্টতম কাজটি করছেন। প্রত্যেকেরই মতামত দেওয়ার অধিকার আছে, কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে তিনি কখনও ধরররমের ভিত্তিতে বিভাজনকে সমর্থন করেন না।
আরও শুনুন: ‘অফসাইডের ঈশ্বরী’… অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ইতিহাস গড়া স্মৃতিকে নিয়েও হোক হইচই
ভারতের মতো দেশে, যেখানে ক্রিকেটই ধর্ম, আবার ক্রিকেটারদের ধর্মের নামে ভাগাভাগিও করা হয়, সেখানে ক্যাপ্টেনের এই বিবৃতি বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। শুধু ক্রিকেট সমর্থকদেরই নয়, এই কথা আসলে আসমুদ্র হিমাচল ভারতবাসীকেই মনে করিয়ে দেয়, ভারতভূমির বৈচিত্র, সহিষ্ণুতার কথা। কোহলির এই পদক্ষেপকে তাই কুর্নিশ জানিয়েছেন ফারহান আখতার, স্বরা ভাস্করের মতো সেলেবরা। সন্দেহ নেই যে, ক্যাপ্টেন কোহলি এই জেনারেশনের কাছে রোল মডেল। তাঁর এই কথা তাই গোটা দেশের তরুণ সমাজের কাছেই একটি বার্তা। একদা মুম্বইয়ে দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সুনীল গাভাসকর। সেই উত্তরাধিকারই বহন করছেন কোহলি। শুধু খেলার মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও। কুর্নিশ তাই প্রাপ্য ক্যাপ্টেনেরও।