খেলোয়াড় জীবনে কখনও বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাসে ভাসতে দেখা যায়নি। বিপক্ষের স্লেজিং হোক বা দুরন্ত গতির বাউন্সার, চোয়াল শক্ত করে ক্রিজে টিকে থেকেছেন ‘দ্য ওয়্যাল’। তবু চ্যাম্পিয়নের বরমাল্য অধরা মাধুরী হয়েই রয়ে গিয়েছে। কোচিং জীবনের শেষ স্টেশনে এসে ন্যায়বিচার পেলেন রাহুল দ্রাবিড়। দেশকে বিশ্বকাপ উপহার দিয়ে বিদায় নিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের মি. ডিপেন্ডেবল। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
ব্যাট-প্যাড তুলে রেখেছেন বহুদিন। সযত্নে নিজেকে আড়াল করেছেন ক্যামেরার যাবতীয় ঝলকানি থেকে। না উচ্ছ্বাস না হতাশা, কিছুই স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে না তাঁর চেহারায়। টিকে থাকাটাই যে আসল কথা, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন রাহুল দ্রাবিড়। কখনও আশা ছাড়তে নেই, একথা বলতেন বারবার। বিশ্বাস করতেন, কোথাও ঠিক ন্যায়বিচার অপেক্ষা করে রয়েছে।
কোচিং জীবনের শেষ স্টেশনে পৌঁছে সেই ন্যায়বিচারটাই পেলেন রাহুল দ্রাবিড়। খেলোয়াড় জীবনে যা পারেননি, কোচ হিসেবে সেই স্বপ্নই সত্যি করলেন রাহুল। তবে এদিন আর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারেননি। ট্রফি হাতে উচ্ছ্বাসে মাততে দেখা গিয়েছে তাঁকেও। বিশ্বকাপ জয়ের আবহে এ দৃশ্য একেবারেই স্বাভাবিক। কিন্তু রাহুলকে এমনটা করতে দেখে অবাক হতেই হয়। এর আগে জেতার আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন রাহুল এমন ঘটনা হাতে গুনে বলা যায়। তাও ট্রফি নিয়ে এমন উচ্ছ্বাস নয়। অথচ খেলোয়াড় জীবনে তাঁর সাফল্যের খতিয়ান নেহাতই কম নয়। মনে পড়ে যায়, ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের টেস্ট জয়। ২২ বছরের খরা কাটিয়ে দেশকে কাঙ্খিত জয় এনে দিলেন রাহুলই। প্রথম ইনিংসে ২৩৩ রান, পরে জয়সূচক আরও ৭২ রান করলেন ‘দ্য ওয়াল’। ক্যাপ্টেন সৌরভের বিশ্বস্ত সৈনিক, ২০০৪ সালে রাওয়ালপিন্ডি টেস্টেও ঝুলিতে ভরেছিলেন ২৭০ রান। এমনই আরও একাধিক ম্যাচে অন্যন্য নজির গড়েছেন রাহুল। শুধু কি ব্যাট হাতে! উইকেট কিপার হিসেবেও যথেষ্ট সফল ছিলেন। স্লিপে দাঁড়িয়ে ২১০টি ক্যাচ ধরার রেকর্ডটিও তাঁর। ১৬ বছরের খেলোয়াড় জীবনে ১৬৪টি টেস্ট খেলেছেন। ওয়ান ডে ম্যাচ খেলেছেন ৩৪৪টি। সাফল্যের স্বাদ যেমন পেয়েছেন, ব্যর্থতাও দেখেছেন বহু। বিশ্বকাপের অনেকটা কাছে পৌঁছেও স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। তবু ভেঙে পড়েননি রাহুল। ক্রিকেট বিধাতার সামনে ন্যায়বিচারের আশায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন ঠায়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পেয়েছেন নতুন দায়িত্ব। বেঙ্গালুরুতে ন্যাশানাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে তরুণ ক্রিকেটারদের তালিম দিয়েছেন দীর্ঘদিন। ‘ইন্ডিয়া-এ’ও অনুর্দ্ধ উনিশ ভারতীয় দলের দায়িত্বও সামলেছেন দ্রাবিড়। তাঁর কোচিং-এই উঠে এসেছেন ঋষভ পন্থ, ওয়াশিংটন সুন্দর, শুভমান গিল, মায়াঙ্ক আগরওয়াল, সাইনি, সিরাজের মতো উঠতি তারকারা। ২০১৬ ও ২০১৯ অনুর্দ্ধ ঊনিশ বিশ্বকাপে এঁরা দ্রাবিড়ের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। পাকিস্তানের কিংবদন্তি ক্রিকেটার ইনজামাম উল হক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,শুধু টেকনিক নয়, দ্রাবিড় যে-কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাঁর নিজের যে মানসিক কাঠিন্য তাকেই চারিয়ে দিতে পারেন তরুণদের মধ্যে। অস্ট্রেলিয়া সিরিজে ঐতিহাসিক কামব্যাকে ভারতের তরুণ প্রজন্মের উত্থানের নেপথ্যেও ছিল দ্রাবিড়ের অদৃশ্য হাত। সেই অন্তরালে থাকা দ্রাবিড়কে একসময় নিয়ে আসা হল ভারতীয় ক্রিকেটের হটসিটে। শাস্ত্রীর পর ভারতীয় কোচের দায়িত্ব নেন রাহুলই।
এখানেও চড়াই উতরাই কম দেখতে হয়নি। একাধিক দ্বি-পাক্ষিক সিরিজে সাফল্য পেলেও, রাহুল জমানায় ICC ট্রফি অধরাই থেকে গিয়েছে। এমনকি ঘরের মাঠে বিশ্বকাপও ঘরে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে ভারতীয় দল। এর জন্য রাহুলের সমালোচনাও হয়েছে। এমনকি ওয়ান ডে বিশ্বকাপে হারের পর রাহুলকে বরখাস্ত করার দাবিও উঠেছিল। চোয়াল শক্ত করে সেসব সহ্য করেছেন রাহুল। পাখির চোখ করেছেন প্র্যাকটিস। বহির্বিশ্বের যাবতীয় প্রত্যাশাকে এতদিন যেভাবে ব্যাট হাতে নিজের মৌনতা দিয়ে শাসন করেছেন, সেই দক্ষতাই দেখিয়েছেন কোচ হিসেবে। আর তাতেই বাস্তব রূপ পেয়েছে তাঁর স্বপ্ন। রোহিত-বিরাটদের থেকে যোগ্য গুরুদক্ষিনা পেয়েছেন রাহুল। তবে এই শেষ। কোচের ভূমিকায় আর দেখা যাবে না রাহুলকে। যদিও শেষবেলায় নিজেকে এতটুকু বদলাননি। বিশ্বকাপে যখন একের পর এক ম্যাচ জিতছে ভারত, নেটদুনিয়া শুরু হল নতুন ট্রেন্ড। দ্রাবিড়ের জন্য বিশ্বকাপ জিতুক দল, চেয়েছিলেন গোটা দেশের মানুষ। একা রাহুল উলটো সুরে কথা বলেছিলেন। কোনও বিশেষ ব্যক্তির জন্য একটা গোটা দল খেলবে এমনটা চাননি রাহুল নিজেই। সবসময় ভালো ক্রিকেটের কথা বলে গিয়েছেন ভারতীয় দলের হেডস্যর। তবে ওই যে কথায় আছে, যা হওয়ার তা হবেই। এক্ষেত্রেও যেন সেভাবেই বিশ্বকাপ জিতেছেন রোহিত-কোহলি-হার্দিকরা। রোমাঞ্চ ভরা ম্যাচে বহু ঐতিহাসিক মুহূর্তে সাক্ষী থেকেছে দেশবাসী। শেষবেলায় সূর্যকুমারের ক্যাচ হোক বা অক্ষর প্যাটেলের দুরন্ত পারফরম্যান্স যেন বুঝিয়ে দিয়েছে ভারতের এই দল চাইলে সব পারে। হয়তো রাহুলের জন্যই বিশ্বকাপ জিতেছেন রোহিতরা। হয়তো বা নিজেদের জন্য। তবু শেষবেলায় একথা বলতেই হয় ভাগ্যিস রাহুল ছিলেন।