আহত হয়ে খেলা থেকে ছিটকে যাওয়া, আর তারপর সেই চোটকে বশ মানিয়ে ফের ক্রিজে ফেরা, এ যেন লড়াইয়ের অন্য এক ইস্তাহার। ক্রিকেট মাঠে নতুন করে সেই অদম্য জেদের গল্প লিখলেন ধোনি-পন্থরা। একজন নতুন করে হাঁটতে শিখেছেন, অন্যজন উঠেছেন হাঁটুর চোট সারিয়ে। সেইসব বাধা কাটিয়েই যেন রাজকীয় ফেরার নিশান ওড়ালেন দুই প্রজন্মের দুই তারকা।
এভাবেও ফিরে আসা যায়! এ কথা বলা আসলে চ্যাম্পিয়নদেরই সাজে। নিজেদের কাজের প্রতি যাঁদের তীব্র প্যাশন, যে কোনও প্রতিকূলতাকে অদম্য জেদে কাটিয়ে উঠে তাঁরা সেই ভালোবাসার কাছে নতজানু হয়ে বসেন। সেই আশ্চর্য ভালোবাসার গল্প বারেবারে লেখা হয় খেলার মাঠে। যেমন জন্মদিনে শচীন তেণ্ডুলকরকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে পুল্লেলা গোপীচাঁদ বলেছিলেন, আমাদের দেশের মাটিতেও জন্ম হতে পারে চ্যাম্পিয়নের। শচীনকে ঘিরেই তাঁর যে এই জোরালো বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসের ভিত পোক্ত করেছিল প্রতিবার চোট আঘাতের বিপর্যয় কাটিয়ে শচীনের ফিরে আসা। আহত হয়ে খেলা থেকে ছিটকে যাওয়া, আর তারপর সেই চোটকে বশ মানিয়ে ফের ক্রিজে ফেরা, এ যেন লড়াইয়ের অন্য এক ইস্তাহার। ক্রিকেট পিচ সত্যিই সেই ভালোবাসার গল্প জানে, যেখানে খেলোয়াড় আর খেলার মাঝে চোট যতবার বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়, ততবার হেরে যেতে হয় বাধাকেই। চলতি আইপিএল-এর শুরুতেই সে কাহিনিতে যেন যোগ হল দুই নতুন পাতার। তার একটায় লেখা তরুণ ঋষভ পন্থের নাম। অন্য পাতায় সদর্পে দাঁড়িয়ে এক বুড়ো ঘোড়া, যার নাম মহেন্দ্র সিং ধোনি। আঘাত তাঁদের আহত করেছে, কিন্তু বেঁধে রাখতে পারেনি, থামিয়ে দিতে পারেনি পিছুটানে।
আরও শুনুন:
ক্যাপ্টেন তৈরির কি কোটা ফ্যাক্টরি হয়? মাঠই অমোঘ পাঠশালা
হাল আমলের ক্রিকেটের নয়া ফরম্যাট বারে বারেই বয়স্ক খেলোয়াড়দের ফেলে দিয়েছে বাতিলের দলে। কিন্তু ধোনি তো সেই রহস্যের নাম, ক্রিকেটের সব জটিল-কুটিল অঙ্কের সমাধান যে ‘এক্স’ ধরে কষা যায়। চলতি আইপিএল-এ প্রথমবার ব্যাট হাতে নেমেই ৪২ বছরের ধোনি বুঝিয়ে দিলেন, এখনও তাঁর ব্যাট বোলারদের ঘুম কেড়ে নিতে পারে অনায়াসে। অথচ, হাঁটুর চোট সারিয়ে সবে মাঠে ফিরেছেন তিনি। গত বারের আইপিএলে বাঁ পায়ের হাঁটু ধোনিকে ভুগিয়েছিল। অনুশীলনের সময়, ম্যাচের শেষে বেঁধে রাখতে হত আইসপ্যাক। আইপিএল শেষে অস্ত্রোপচারও করতে হয়। এমনকি এবারের ম্যাচেও মাঠ ছাড়ার সময় স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারছিলেন না ধোনি। ম্যাচ শেষে দেখা যায় তাঁর বাঁ পায়ের কাফ মাসলে আইসপ্যাক বাঁধা। কিন্তু চোট নিয়েও চারটে চার আর তিনটে ছয় উপহার দিয়ে বিশাখাপত্তনমের হলুদ জার্সিভরা গ্যালারিকে মাতিয়ে দিলেন চেন্নাইয়ের সিংহ। যা আরও একবার, যে কোনও ক্রিকেটপ্রেমীকে ব্যক্তিগত লড়াইয়ের সাহসও জুগিয়ে দিয়ে গেল।
আরও শুনুন:
পিঠেতে টাকার বোঝা, তাই জরুরি স্টার্কের উইকেট খোঁজা?
আসলে, ক্রিকেট মাঠের লড়াইটা এগারো জনের। কিন্তু মাঠে ফিরে আসার লড়াইটা ব্যক্তিগতই। তা সে সৌরভের কামব্যাকের গল্প হোক কি কোহলির সেঞ্চুরিতে ফেরার রূপকথা। আর সেই কামব্যাকের পিছনে যদি কাঁটা উঁচিয়ে থাকে চোট আঘাতের রক্তাক্ত দিনলিপি? সেই দিনলিপি যে কারও একেবারে একার। সেই লড়াইটা তাঁকে লড়তে হয় একা, লোকচক্ষুর অন্তরালে, নিজের সঙ্গে নিজে। ঠিক যেমনটা লড়তে হয়েছে ঋষভ পন্থকে। গত দেড় বছর বিছানায় শুয়ে, ক্রাচ হাতে হাঁটার মাঝে এই ফেরার গল্পটা তিনি লিখে চলেছিলেন একটু একটু করে। আরও একবার ব্যাট হাতে মাঠে নামার স্বপ্ন, আরও একবার একহাতের ছক্কায় বোলারকে উড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন, আরও একবার দলকে জেতানোর স্বপ্ন… এই সব স্বপ্নগুলোই বোধহয় তাঁকে নতুন দৌড়টা শুরু করার জন্য জ্বালানি জুগিয়ে চলেছিল। না হলে, পাহাড়ের মাথা থেকে আছড়ে পড়ার পর ফের সিসিফাস হওয়ার মতো জোর সহজে আসে না। নতুন করে পাহাড় বেয়ে ওঠাকে তখন অসম্ভব বলেই মনে হয়। আর সেই উঠতে গিয়ে আবার, আবার গড়িয়ে পড়া, উঠে ফের শুরু করা… হাল ছেড়ে দেওয়া আর না-দেওয়ার এই টাগ-অফ-ওয়ার পেরোতে পারে কজন! যে সময় তাঁর কেরিয়ার দৌড়চ্ছে রেসের কালো ঘোড়ার মতো, সেই সময়েই মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন পন্থ। সেই ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনার পর তিনি মাঠে আর কোনও দিন ফিরতে পারবেন কি না, তা নিয়েই আশঙ্কায় ছিলেন তাবত অনুরাগীরা। গত দেড়-দেড়টা বছর বিছানায় শুয়ে থেকেছেন। ক্রাচ হাতে নিয়ে হাঁটতে শিখেছেন প্রায় নতুন করে। সেই ঋষভই ৯০৩ দিন পরে আইপিএলে অর্ধশতরান করে দলকে জেতালেন ফের। ফের তাঁর এক হাতের ছক্কা উড়ে গেল মিড উইকেটের উপর দিয়ে। আর এই গোটা ইনিংসটা জুড়েই উড়ছিল রাজকীয় এক ফেরার নিশান। যে নিশান হয়তো পথ দেখাতে পারে হাল ছেড়ে দিতে বসা যে কোনও মানুষকেই। তাই ঋষভের খেলার সময় গ্যালারিতে এক পোস্টার বলছিল, ‘তুমি কখনও একা হাঁটবে না’। হেরে যাওয়ার পর, ভেঙে পড়ার পর যেসব ফিরে আসার লড়াই, তা নিঃসন্দেহে একারই। কিন্তু সেই প্রতিটি একা লড়াই-ই তো আসলে এক মিলিত দৌড়ের গল্প লেখে। সেই ম্যারাথনে এবার নতুন করে জয়ের নিশান উড়িয়ে দিলেন ধোনি-পন্থরা।