নীতিশের সেলিব্রেশন যেন আমাদের বলে, সুপারহিরোরর বাস শুধু সিনেমার বাস্তবতায় নয়। পর্দায় নয়। জীবনের গোপন প্ররোচনাও থাকে এক একটি মুহূর্তকে অতিকায় করে তোলার ক্ষেত্রে। আর কেউ না জানুক, নীতিশ জানেন, তাঁর বাবার চোখ থেকে ঝরে আনন্দের অশ্রুই আসলে লার্জার দ্যান লাইফ।
অবাস্তব। কল্পকাহিনি। অবিশ্বাস্য। লার্জার দ্যান লাইফ যে সব গল্পগাছা, সেখানে নাকি গল্পের গরু ওঠে গাছে। বাস্তবের সঙ্গে সে-সব গল্পের নাকি জমিন-আসমান ফারাক। হয়তো সত্যি! কিংবা নয়। বাস্তবের ভিতরেই হয়তো নিহিত ওই লার্জার দ্যান লাইফ হয়ে ওঠার ইচ্ছে। তাই যত নিন্দা-অপবাদই থাক না কেন, সুপারহিরোরা সময় সময় পর্দায় আসেন। আর মানুষ সেই সব অতিকায় চরিত্রদের মধ্যেই নিজেদের স্বপ্ন আর সাধের সত্যি হয়ে ওঠা দেখতে পান। সাধ্যের সীমা যেখানে পেরিয়ে যায়, সেই প্রসারিত বাস্তবতায় সুপারহিরোর সঙ্গে একান্তে হয়তো নিজেদের মিলিয়েও নেন। বাস্তবের পরিস্থিতি মানুষকে যেভাবে ছোট আর খাটো করে রাখে, তা থেকে যেন এক লহমার মুক্তি! তবে, এমন সময়ও আসে, যখন এই সুপারহিরো আর শুধু কল্পচরিত্র হয়ে থাকে না। এই বাস্তবের ধুলোমাটিতেও, এমন কোনও দৃশ্যের জন্ম হয়, যা লার্জার দ্যান লাইফ হয়ে ওঠে নিজ গুণে। ঠিক যেমন নীতিশ কুমার রেড্ডির সেঞ্চুরি।
মেলবোর্নে দলের চাপের মুখে সেঞ্চুরে হাঁকিয়েছেন তরুণ ব্যাটার। তাঁর কেরিয়ারের মাইলফলক এই মুহূর্ত। তবে, চাপের আগুন থেকে ফিনিক্স হয়ে যাওয়ার নমুনা তো কম নয়। তাহলে নীতিশের সঙ্গে পর্দার অতি-বাস্তবতার তুলনা আসছে কোথা থেকে? সে জমি খানিকটা তৈরি করেছেন নিজেই। অর্ধ-শতরান করে তিনি ফিরিয়ে এনেছেন ‘পুষ্পা’ সেলিব্রেশন। আর শতরান ঝুলিতে পুরে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি-ই ‘বাহুবলী’। নীতিশ তরুণ। ফলত তাঁর সেলিব্রেশনে সাম্প্রতিক সিনেমার অনুষঙ্গ থাকা খুবই স্বাভাবিক। সম্প্রতি দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে অল্লু অর্জুনের ‘পুষ্পা ২’, আর প্রভাসের ‘বাহুবলী’ তো ভারতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে প্রায় মহাকাব্যিক মহিমা পেয়েছে। একজন তরুণের মনে এই দুই ছবির ছাপ থাকা এবং সেলিব্রেশনের মুহূর্তে তা ফিরে আসা তাই সহজাত বলেই ধরা যায়।
কেউ কেউ বলতে পারেন, বিগত কয়েক বছরে দক্ষিণের ছবি যেভাবে জাঁকিয়ে বসেছে ভারতীয় দর্শকের মনে, মেলবোর্নের মাঠে যেন তারই ছায়া দেখা গেল। এ-কথা অবশ্য মোটেও বাড়িয়ে বলা নয়। করোনা পরবর্তী কালে শাহরুখ খানের পাঠান-জওয়ানের হাত ধরে হিন্দি সিনেমার দুনিয়া খানিকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। চব্বিশে সেই সাফল্যের ধারা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন অজয় দেবগণ, কার্তিক আরিয়ানরা। তবে গত কয়েক বছর ধরে ভারতীয় সিনেমায় ধারাবাহিক ভাবে সফল দক্ষিণী মূলধারার সিনেমাই। ‘বাহুবলী’, ‘পুষ্পা’, থেকে ‘আরআরআর’-এর মতো সিনেমা একের পর এক এসে বুঝিয়ে দিয়েছিল, লার্জার দ্যান লাইফের প্রতি মানুষের আসক্তি ঠিক কতখানি। তা নতুন নয়। তবে, নতুন সময়ের নিরিখে তা অন্য মাত্রা পায়। দেখা গিয়েছে, যখন বাস্তবের চাপে মানুষ ক্রমাগত কুঁকড়ে গিয়েছে, তখনই কোনও এক লার্জার দ্যান লাইফ চরিত্রকেই সে নিজের মসিহা মনে করেছে। সে অ্যাংরি ইয়াং ম্যান হোক বা পুষ্পা – এই প্রবণতার ব্যতিক্রম নেই। অর্থাৎ এই ধরনের অতিকায় চরিত্রের উদ্ভবের মধ্যে সামাজিক বাস্তবতা থাকে। থাকে খুব সন্তর্পণেই। যা বাস্তবতারহিত বলে মনে হয়, তা কিন্তু বাস্তবতাবর্জিত নয়।
আর ঠিক এখানেই নীতিশের সেলিব্রেশন আলাদা গুরুত্ব রাখে। আসলে নীতিশ সেলিব্রেট করেছেন জীবনের এই চলকে পড়াটুকুকেই। এক তো চাপের মুখে বুক চিতিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া। ভারতের রথী-মহারথীদের সাজঘরে ফিরে যাওয়া। অস্ট্রেলিয় বোলারদের দাপট। ক্রমাগত ভয় দেখিয়ে যাওয়া। কঠিন পরিস্থিতি। আর সেখানে একুশ বছরের এক যোদ্ধার দাঁতে দাঁত চেপে চালিয়ে যাওয়া লড়াই। এবং অবশেষে সাফল্যের স্টেশনে পৌঁছনো। অতিকায় হয়ে ওঠার ইন্ধন তো লুকিয়ে থাকিয়ে এই সব মুহূর্তেই। ফলত লার্জার দ্যান সেলিব্রেশন ফিরবে নাই-ই বা কেন!
তা ছাড়া জীবন তো নীতিশকে নিয়ে কম খেলা খেলেনি! ছেলেকে ক্রিকেটার বানাতে প্রায় সর্বস্ব বাজি রেখেছিলেন নীতিশের বাবা। তাও গোড়ার দিকে খেলা নিয়ে তেমন সিরিয়াস ছিলেন না নীতিশ। সে কথা বলেছেন নিজেই। তারপর একদিন বাবাকে কাঁদতে দেখলেন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা, ছেলের ভবিষ্যৎ- এই সব নিয়েই দুশ্চিন্তায় সেদিন কেঁদে ফেলেছিলেন ভদ্রলোক। সেই দুঃখের কান্না থেকে মেলবোর্নের মাঠে তাঁর আনন্দের অশ্রু- এই সফর সম্ভব করে তুলেছেন নীতিশ নিজে। তাঁর শ্রমে-দক্ষতায়। জীবনের প্রতিকূলতা জয় করার লড়াইয়ে। নীতিশ হয়তো আরও সফল হবেন। সাফল্য তাঁর অভ্যাসে পরিণত হবে। তবে আজ এই যে এক ছাপোষা স্বপ্নের বাস্তব হয়ে ওঠা, এ-ও কি লার্জার দ্যান লাইফ নয়!
নীতিশের সেলিব্রেশন তাই যেন আমাদের বলে, সুপারহিরোরর বাস শুধু সিনেমার বাস্তবতায় নয়। পর্দায় নয়। জীবনের গোপন প্ররোচনাও থাকে এক একটি মুহূর্তকে অতিকায় করে তোলার ক্ষেত্রে। আর কেউ না জানুক, নীতিশ জানেন, তাঁর বাবার চোখ থেকে ঝরে আনন্দের অশ্রুই আসলে লার্জার দ্যান লাইফ।