ছেলেটির সব গল্পগুলোই সত্যি। কোনোটিকেই অস্বীকার করা যাবে না। তবে, শাশ্বত কেবল তার আর তার ব্যাটের রূপকথা। সে রূপকথা অন্তহীন। ছেলেটি আসলে আধুনিক ক্রিকেটের গোপাল-রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস। বিশ্ব তার নাম দিয়েছে বিরাট কোহলি।
ছেলেটি মেজাজি, খেয়ালি। কেউ কেউ বলে থাকেন, ছেলেটি খানিক উদ্ধতও। মাঠে, মাঠের বাইরেও। ছেলেটি আগ্রাসি মেজাজমর্জি কোনোদিন লুকিয়ে রাখতে শেখেনি। ফলত প্রবল সমালোচিত। ছেলেটি তার আবেগের সামনে বাঁধ দেয়নি কোনোদিন। ফলত ছেলেটি বেশ ‘আনপ্রেডিক্টবল’। কখন যে কী বলে ফেলবে, কী করে ফেলবে তার যেন আগাম আন্দাজ মেলে না। পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের ছাঁচে ছেলেটি নিজেকে ফেলতে চায়নি কোনোদিন। ফলত ছেলেটি একেবারে স্বতন্ত্র। কোনও চেনা টেমপ্লেটে তাকে ফেলা যায় না। ছেলেটি তাই একদিন তৈরি করে তার নিজস্ব আদল, নিজস্ব ছাঁচ। বিশ্ব তা চেনে কোহলিয়ানা নামে।
ছেলেটির গল্প অবশ্য এখানেই ফুরোয় না। বরং এইসব কথাবার্তা যেখানে শেষ হয়, সেখান থেকে শুরু হয় তার নিজস্ব গল্প। ছেলেটি নদীর মতো। বেগবান, আপন বেগে পাগলপারা। ছেলেটি তার ব্যাটের সঙ্গে গল্প করতে ভালোবাসে। একান্ত সেই কথোপকথনের সাক্ষী থাকে না পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ। ছেলেটি জানে, তার ব্যাটেরও মন আছে। কখনও সেখানে এসে জমে অভিমান। সপ্রেম দৃষ্টিতে তখন সে তাকিয়ে থাকে তার চিরকালের সঙ্গীটির দিকে। ছেলেটির ব্যাটটিও জানে, ছেলেটি মনের ভিতর কেমন চলে তোলপাড়। আর তাই যেদিন সে কুঁকড়ে যায়, হতাশার মেঘ যেদিন আচমকা দেখে দেয় ছেলেটির আকাশ, সেদিন তার ব্যাট কথা বলে ওঠে। এই গল্পটার আদতে কোনও নাম নেই। তবু, কোনও একটা নাম তো দিতেই হয়। অনেক ভেবেচিন্তে বিশ্ব তার নাম দিয়েছে বিরাট-ম্যাজিক।
আরও শুনুন: ভিড়ের মাঝেও ‘বিরাট’ একা, লড়াইয়ের সঙ্গে ভালোবাসার মন্ত্রও শেখান কিং কোহলি
ছেলেটির গল্পে কি তবে এবার ইতি টানার সময় এল। মোটেও না। আসলে ছেলেটির কাহিনি তো এক বহুস্তরীয় উপন্যাসের মতোই। ঠিক যেখানে মনে হয়, এই বুঝি কিনারা মিলল, সেখান থেকেই খুলে যায় অন্য পরত। ছেলেটি দেখে এসেছে তার ঈশ্বরদের। ধর্মপ্রাণ এ দেশে অবতারের জন্ম তার অজানা নয়। ঘটনাচক্রে ছেলেটিও একদিন এসে দাঁড়ায় সেই অলৌকিকের পথে। ছেলেটি বুঝতে পারে, তার আর তার ব্যাটের গল্পটা এই নতুন ভারতের সফলতার এক অনন্য আখ্যান। তবে সেই আখ্যানকে শুধু হয়ে উঠলেই হবে না। হয়ে-ওঠার পথে তাকে পালন করতে হবে অনেক দায়িত্ব। এই দেশ, সমাজ, এই ভারতের কোটি কোটি মনের চাহিদা তাকে মেটাতে হবে তার মননের মধু দিয়েই। ছেলেটি একদিন বুঝে যায়, ঈশ্বর সে হতে চাক বা নাই-ই চাক, অধুনা পৃথিবীর সার্থক বিগ্রহ তাকে হতেই হবে। ছেলেটি যেন, খানিক বিস্ময়েই সে পথ ধরে এগোতে থাকে।
আর একদিন সেই পথের উপর এসে দাঁড়ায় তীব্র খরা। বিতর্কের আগুন তখন পুড়িয়ে দিচ্ছে পরিবেশ। ছেলেটি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ফেলছে তার পূর্বসূরিদের। কতটা ঠিক আর কতটা ভুল? বিচারের ভার মহাকালের হাত। ছেলেটি জানে, তার থামার কোনও উপায় নেই। অথচ সামনেই খরা যেন ওত পেতে বসে আছে তার সর্বস্ব গ্রাস করবে বলে। ছেলেটা দেখতে থাকে, একে একে পেরিয়ে যায় হাজার দিনেরও বেশি। তার আর তার ব্যাটের গল্পের ভিতর যেন ঢুকে পড়েছে বেপথু কোন হাওয়া। তার হাতের জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ ব্যাট যেন আর তার নিজের কথাই শুনতে চায় না। ছেলেটি বিস্মিত হয়। আবার হেসেও ফেলে।
এই পথের শেষ কোথায়? ছেলেটি জানত, তাকে ফিরে পেতে হবে তার নিজস্ব গল্পখানা। ব্যাটের সঙ্গে তার যে একান্ত আলাপন, একদিন যাকে সে টেনে এনেছে বহুচোখের সামনে, আলোকমালার নিচে, আতশকাচের তলাতেও, তাকে সে হারিয়ে যেতে দিতে পারে না। মনে মনে সে তাই তার ব্যাটকে বুঝি বলে, ভালোবাসা নিয়ো হারিয়ে যেও না। এই গল্পের আগামী পর্বগুলি যে তাদের দুজনকেই লিখতে হবে, ছেলেটির থেকে ভালো আর তা কে জানত! একদিন অভিমান ভাঙে। মেঘ কেটে যায়। রোদ ওঠে দুজনের সম্পর্কে। পৃথিবী দেখে, গল্পটায় আবার নতুন রং লেগেছে। সেই রং ছেলেটাকেও চেনাচ্ছে নতুন করে। ছেলেটি এখন অনেকটাই শান্ত। ছেলেটি এখন তার চারপাশের ঝড়ো হাওয়াকে ততটাও আর গুরুত্ব দেয় না। বরং তার আর ব্যাটের গল্পটাকেই দিতে থাকে ধ্রুপদী মাত্রা। বিশ্ব তাকে আদর করে কিং কিংবা কিংবদন্তি বলে।
ছেলেটার গল্পটা তাই শেষ হয় না। বরং প্রতিদিন নতুন করে শুরু হয়। রেকর্ডের মাইলস্টোন সে এক এক করে পেরিয়ে যেতে থাকে স্মিত হাসি হেসে। জন্মদিনে ছেলেটি সবকিছু ছাপিয়ে আবার ফিরে যায় তার ব্যাটের কাছে। সেই ব্যাট- যে কিনা তার নিজস্ব অন্ধকারে অনন্ত নক্ষত্রবিথী। আর আলোর মালায় সাজা ইডেন এক লহমায় খেয়াল করে, ছেলেটি তার গল্পের আরও এক নতুন অধ্যায় লিখে ফেলেছে। জন্মদিনের সাফল্যের গল্পগাছার মাহাত্ম্য আলাদা। মিডিয়া তা নিয়ে মুখর হবে, ছেলেটি জানে। তবে মনগহনে সে জানে, জন্মদিনে সেঞ্চুরি স্রেফ ঘটনা মাত্র। আসলে প্রতিটি সেঞ্চুরিই তার নতুন জন্মদিন।
ছেলেটির সব গল্পগুলোই সত্যি। কোনোটিকেই অস্বীকার করা যাবে না। তবে, শাশ্বত কেবল তার আর তার ব্যাটের রূপকথা। সে রূপকথা অন্তহীন। ছেলেটি আসলে আধুনিক ক্রিকেটের গোপাল-রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস। বিশ্ব তার নাম দিয়েছে বিরাট কোহলি।