সুখের দিনে অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস নেই। দুঃখের দিনে উদ্বিগ্ন নয় মন। সকলে এমনটা হতে পারেন না। রাজার ঐশ্বর্য আর সন্ন্যাসীর বৈরাগ্য একযোগে সকলে অন্তরে ধারণ করে বসন্ত হয়ে উঠতে পারেন না। যাঁরা পারেন, তাঁরা সাধক। ভারতীয়দের সাধনার সেই একান্ত ধারাটি কী অনায়াসে নিজের ভিতর বইয়ে দিতে পারেন হাবাস। আন্টোনিও লোপেজ হাবাস। শুধু ফুটবলে নয়, আপনি আচরি ধর্ম তিনি অনেকের কাছেই হয়ে উঠতে পারেন জীবনে হার্ডল অতিক্রমের টেক্সটবুক।
লিখলেন, অর্পণ গুপ্ত। পড়লেন, শঙ্খ বিশ্বাস।
‘বোরোলীন’ ছাড়াও যদি বঙ্গজীবনের অঙ্গ কিছু থেকে থাকে তবে তা হল আবেগ। বাঙালি আবেগপ্রবণ। আনন্দে আত্মহারা, শোকে মুহ্যমান, হরষে উচ্ছ্বসিত, বিরহে কাতর। সমষ্টির স্নায়ুতে এই আবেগের স্রোত বাঙালির অস্থিমজ্জাগত। ক্রীড়াসংস্কৃতির বা বলা ভাল ফুটবল-সংস্কৃতির যে রূপোলি পর্দা এখনও টানটান, তাতে যে কাব্যিক নায়ককে বাঙালি দেখতে চায় – যেখানে সে দেখেছে পিকে-অমল, দেখেছে সুব্রত-সুভাষ; – সেই অবয়বের ধারে কাছেও থাকেন না মোহনবাগানের কোচ আন্টোনিও লোপেজ হাবাস।
মোহনবাগান হেরে গেল আইএসএল কাপ ফাইনাল। মিডিয়ার তির্যক প্রশ্নের সামনে নিখুঁত ফ্রন্টফুট ডিফেন্স করে গেলেন হাবাস। অমল দত্ত বড় ম্যাচের আগে ওমোলোকে অমলেট, সোসোকে শশা, বাইচুং-কে চুংচুং বলেন; পিকে ‘খেলা তো মাঠে হয়’-এর মতো শীতল অথচ শাণিত ভরসা দেন, সুব্রত ভট্টাচার্যের প্রেস কনফারেন্সে হোসে মোরিনহোর মতো মেজাজ, এমনকী মোহনবাগানের আইলিগজয়ী কোচ সঞ্জয় সেনের গলাতেও যে আবেগী ময়দানী গন্ধ- তার ছিঁটেফোটা নেই হাবাসের যাপনে। একজন আইএসএল লিগ-শিল্ড জয়ী কোচ, শিল্ড জয়ের পরের দিন ঘোষণা করে দেন কোনও সেলিব্রেশন যেন না করা হয়, কারণ নকআউটে খেলা তখনও বাকি। অথচ, এ-কথা আমরা সকলেই জানি, আইএসএলের কাপের চেয়েও জরুরি হল শিল্ড, যা সরাসরি এসিএলটু-র গ্রুপ স্টেজে নিয়ে যাবে দলকে; সেই শিল্ড জয়ের পরেও এত উচ্ছ্বাসহীন থাকা কীভাবে সম্ভব? হাবাস পারেন বলেই তিনি হাবাস।
যেখানে ডার্বিজয়ের পর কোচেরা কয়েকদিন প্লেয়ারদের বিশ্রাম দেন, ছুটি দেন, সেখানে হাবাস লিগজয়ের পর নামমাত্র ছুটির পরেই প্র্যাকটিসে হাজির হয়ে গেলেন পুরো টিম নিয়ে। আসলে হাবাস জানেন, তিনি একজন পেশাদার কোচ। তিনি মোহনজনতার আবেগের শিকড়টিকে বেঁধে দিতে চান আরও উঁচু তারে। এ যেন নিঃশব্দে প্রতিষ্ঠা করা এক সারসত্যকে- ‘জয় কোনও গন্তব্য নয়। চ্যাম্পিয়নদের কাছে জয় আসলে একটা অভ্যাস।’ বাংলার জলহাওয়ায় এ-সত্য প্রতিষ্ঠা করতে তিনি নিরলস। হাবাসের কোচিং, প্ল্যানিং, স্ট্র্যাটেজি নিয়ে অসংখ্য আলোচনা হয়, কিন্তু হাবাসের এই শচীনীয় অধ্যাবসায় কিংবা আদ্যোপান্ত পেশাদারী সংযম আমাদের জীবনে এক বিরাট টেক্সটবই হয়ে থাকে। মাটিতে পা রাখো- পরাজয় আমাদের সংগঠিত করে৷ নিজেদের দিকে তাকানোর কথা বলে। আত্মসমীক্ষার কথা বলে। কিন্তু জয় আমাদের সামনে এক বিশাল বিভ্রান্তির আলো জ্বেলে রাখে- সে আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার সমস্ত সম্ভাবনাটুকুকেই তিনি চান মুছে দিতে। তাই ডার্বি জয়ের পরদিন কাঁটায় কাঁটায় সময় মেপে মাঠে আসেন, মিডিয়ার সামনে রোবটের মতো বাইট দেন আর প্র্যাকটিস সেশনে বাঁশির বদলে ধরে থাকেন কড়া শাসনের ইমানদণ্ডটি৷ দলের প্লেয়ারদের কাছে সম্ভ্রম তিনি আদায় করেন, আবার প্রত্যেকের কার্যক্রম বুঝিয়ে দেন নিখুঁতভাবে।
ফলাফলের দিকে তাকালে দেখা যাবে, মোহনবাগান হেরে গিয়েছে মুম্বইসিটিএফসি-র কাছে। ঘরের মাঠে। গ্যালারিভরা সমর্থনের সামনেও এই হাবাসের দল আত্মসমর্পণ করেছে কার্যত। অনেকে বলছেন এই হার মারাকানাজো। অর্থাৎ, পঞ্চাশের বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো অঘটন। কিন্তু এ হার বাকি দুনিয়ার কাছে ‘a Bad day in Office’ হলেও হাবাসের কাছে একটি পরীক্ষার স্যাম্পেলমাত্র। যেমন শেষবার ২০২১ ফাইনালে হারের ত্রুটি সারিয়ে তিনি শিল্ড ফাইনাল জিতে নেন, যেভাবে শেষবার সরে যাবার আগে লিগে খারাপ পারফরম্যান্সের কাঁটাছেঁড়া করে তিনি এবারে সাইডলাইনের ধার থেকে অপরাজিত থেকে লিগ জেতান, সেভাবেই এই হার নিশ্চিতভাবে হাবাসের আতশকাচের নিচে পড়ে পরেরবার ফিরে আসবে জয় হয়ে।
হাবাসের নিজস্ব পৃথিবীর কাছ থেকে এ-শিক্ষা আমাদের জীবনে উঠে আসা আশু প্রয়োজন- সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার মাঝে আবেগের রাশ নিয়ন্ত্রণ করে লক্ষ্যে অবিচল থাকার শিক্ষা।