ফুটবলের সঙ্গে দারিদ্র্যের সমানুপাতিক সম্পর্ক, অনেকেই বলে থাকেন। কে জানে, দারিদ্র্য থেকেই হয়তো দৌড়টা শুরু হয়, দূরে যাওয়ার জন্য। আর সেখান থেকেই উঠে আসেন দি মারিয়া-রা।
সে বাড়িটায় জলছবি আর রংমশালের গল্প ছিল না। ছিল না রূপকথার পায়রাদের গল্পও। কেবল একটা বল ছিল। যতবার সেই বলকে দূরে ছুড়ে দিত রোগা পায়ের সপাট মার, ততবার, একবেলা খেতে না পাওয়ার কথা ভুলে যেতেন অ্যাঞ্জেল দি মারিয়া। ভুলে যেতেন, বাবার কয়লার কাজের দরুন সেই বাড়িটার দেওয়ালের রং সাদা থেকে ক্রমশ কালোর দিকে এগোচ্ছে। ঠিক তাঁদের জীবনের মতোই, যে জীবনটা অভাব অন্ধকার আর না-পাওয়ার সবটুকু রংহীনতা মেখে নিচ্ছে রোজ। কয়লাখনির কাজে কতটুকুই বা আয়! তবুও, সেটুকুই তখন বেঁচে থাকার খড়কুটো। বাড়িতেই টিনের ছাদ থেকে চুঁইয়ে পড়া গরমের মধ্যে বসে চারকোল তৈরি করতেন বাবা। বেশি করে তৈরি না হলে খাওয়া জুটবে না, তাই বাবার কাজে হাত লাগাতেন দি মারিয়া আর তাঁর বোনও। কয়লার গুঁড়ো উড়ে এসে পড়ত চোখে মুখে। হাত কালো হয়ে যেত। জামাকাপড়ে, গায়ে, বাড়ির দেওয়ালে লেগে থাকত সেই নাছোড়বান্দা কালো রং। আর সেই কালো বাড়ি থেকেই সবুজ মাঠে পা রেখেছিলেন দি মারিয়া।
আরও শুনুন:
ষোলোর সোলো শোয়ে নক্ষত্রের জন্ম, ইয়ামালের রূপকথা যেন মতি নন্দীর উপন্যাস
সবুজ, জীবনের রং। কিন্তু সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটা কি জানত, একদিন এই সবুজই তাকে সত্যিকারের একটা জীবন দেবে? কালো বাড়ির বাইরে, এক আকাশ আর বিশ্বজোড়া মাঠের জীবন? কালো কয়লার স্তূপ থেকে একদিন খুঁজে পাওয়া যাবে এক ঝলমলে হিরে? নাহ্, জানা ছিল না। সেদিনের সবুজ মাঠ কেবল একটা ছুট ছিল, কালো বাড়ি থেকে দূরে যাওয়ার ছুট। দুরন্ত ছেলেকে সামলাতে ফুটবলে জুড়ে দেওয়া। সঙ্গী হয়েছিল একটা বল আর একজোড়া বুট। মাঠজুড়ে দৌড়ের ধকলে সে সস্তার বুট জবাব দিত প্রায়দিনই। তখন ভরসা মা। নতুন জুতো কেনার সাধ্য কী, মা আঠা দিয়ে জুড়ে দিতেন ছেলের বুট। তাতেও গোলে কমতি ছিল না। রোজারিও ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের নিয়ম ছিল, কোনও দল শুরুর দিকেই বেশি গোল করে ফেললে হাফটাইমেই খেলা শেষ। বছর ছয়েকের দি মারিয়াকে কোচ লাগাতার বুঝিয়ে যেতেন, কম গোল কোরো, যাতে খেলাটা পুরো সময় জুড়ে টানা যায়। সেই খেলার জোরেই এল টোরিতো থেকে দি মারিয়াকে কিনে নিল রোজারিও সেন্ট্রাল, ট্রান্সফার ফি মাত্র ৩৫টি ফুটবল।
ফুটবলের সঙ্গে দারিদ্র্যের সমানুপাতিক সম্পর্ক, অনেকেই বলে থাকেন। কে জানে, দারিদ্র্য থেকেই হয়তো দৌড়টা শুরু হয়, দূরে যাওয়ার জন্য। সেখান থেকেই উঠে আসেন দি মারিয়া-রা। এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, কী প্রবল পরিশ্রম তাঁর বাবা আর মা করতেন, তাঁকে ফুটবলার বানানোর জন্য। একটা সাইকেলের পিছনে ছেলেকে চাপিয়ে রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে মা পৌঁছে যেতেন ফুটবল কোচিং ক্যাম্পে। তারপরেও কি পথ সহজ হয়? রোগাপাতলা ছেলে, সেন্ট্রালের কোচই বলছেন, কিচ্ছু হবে না তাঁর দ্বারা। বাবা সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন, এক বছরের মধ্যে কিছু না হলে আমার সঙ্গে কাজে নামবে।
আরও শুনুন:
ফুটবল যেখানে ভালোবাসা, ফুটবল যেখানে দেশপ্রেম
কিছু হবে কি? সেদিন দি মারিয়া যে উত্তরটা আঁতিপাঁতি করে খুঁজেছিলেন, আজ গোটা বিশ্ব তার উত্তর জানে। ২০ বছর বয়সে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে জায়গা, মেসির সঙ্গে জুটি বেঁধে অলিম্পিকে সোনা, আর্জেন্টিনার জার্সিতে ১৪৪টি ম্যাচে ৩১টি গোল। বিপক্ষের ডিফেন্ডারকে চরকি পাক খাইয়ে গোল আর অ্যাসিস্টে ঝুলি ভর্তি। পায়ে চোট, ঊরুর পেশি ছিঁড়ে গিয়েছে, নিজের ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ বদলি পেয়ে গিয়েছে তাঁর, তার পরেও সেই ছোট্ট ছেলেটার দৌড় বুকের মধ্যে পুরে রেখেছেন দি মারিয়া। আর মনে রেখে দিয়েছেন রোজারিওর সেই কালো বাড়ি। সেজন্যই হয়তো, কোনও কিছুতেই দৌড় থামেনি তাঁর। বিশ্বকাপের পর কোপা আমেরিকার ফিনিশিং লাইন ছুঁয়ে এবার নিজেই থামলেন দি মারিয়া। মেসি চোট পেয়ে উঠে যাওয়ার পর ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড হাতে গলিয়ে নিয়ে দেশকে জয়ের মুকুট পরিয়েছেন। এবার তো থামাই যায়। আর এবারই তো থামা যায়।
তবে গল্প তো থামে না। গলিঘুঁজির যত জীবন ফুটবলের রাজপথের উদ্দেশে দৌড় শুরু করছে, তাদের জন্য রয়ে গেল আস্ত একটা রূপকথা। যে রূপকথায় সিলমোহর করে দিলেন দি মারিয়া।