দুয়ারে একদিনের ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ। ওদিকে সদ্য সমাপ্ত হওয়া ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের ভরাডুবি। তবু বিশ্বকাপ নিয়ে আশাবাদী অধিনায়ক রোহিত শর্মা। তিনি সান্ত্বনা দিচ্ছেন বটে, কিন্তু অনুরাগীরা ভরসা পাচ্ছে কই? আর যাই হোক, তিনি তো ধোনি নন! লিখছেন, শঙ্খ বিশ্বাস।
এদিকে দুয়ারে একদিনের ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ, আর ওদিকে সদ্য সমাপ্ত হওয়া ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের ভরাডুবি। চূড়ান্ত ব্যর্থ অধিনায়ক রোহিত শর্মা থেকে শুরু করে বিরাট কোহলি, আইপিএল হিট শুভমান গিলরা। প্রস্তুতির অভাব চোখে পড়েছে প্রত্যেক পদে পদে। সে ব্যাটিং হোক বা অধিনায়কের রণনীতি। পরিকল্পনার কঙ্কালসার চেহারা ও তা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এত কিছুর পরও আমাদের অধিনায়ক রোহিত শর্মার দাবি,‘বিশ্বকাপে অন্য ভারতকে দেখা যাবে’! বিসিসিআই ইতিমধ্যেই ওয়ার্ল্ড কাপের সময়সূচি ঘোষণা করেছে। ওয়ার্ল্ড কাপ আয়োজনের প্রস্তুতিও তুঙ্গে । টুর্নামেন্ট আয়োজনের প্রস্তুতি যতই থাকুক আর রোহিত শর্মা যতই আকাশকুসুম দাবি করুন, মাঠে নামার জন্য কী আমাদের জাতীয় দল আদৌ প্রস্তুত ? ঠিক যেন ভরসা পাচ্ছেন না অনেকেই।
আরও শুনুন: মোদির জন্য নয়, দেশের জন্য পদক জিতেছেন, কুস্তিগিরদের হয়ে সুর চড়ালেন কীর্তি আজাদ
সালটা ২০১৩। আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মুখ দেখেছিল ভারত। অধিনায়ক ছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। এবং ওটিই ছিল আমাদের জেতা শেষ আইসিসি ট্রফি। ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। এই দশ বছরে কত কিছু বদলেছেই, বিরাট কোহলি দলের অধিনায়ক হলেন, শচীন অবসর ঘোষণা কররলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতন একটা স্পনসরহীন টিমও ওয়ার্ল্ড কাপ জিতে গেল, পাকিস্তান চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মুখ দেখে ফেলল, এমনকি ইংল্যান্ডও শেষমেশ ক্রিকেটের সবথেকে বড় ট্রফি ওয়ার্ল্ড কাপ ঘরে তুলল। শুধু পাল্টালো না ভারতের আইসিসি ট্রফির ভাগ্য। আমরা ভারতীয়রা, যাদের কাছে ক্রিকেটটা অনেকটা ধর্মের মতন, তারাও যেন হাল ছেড়েই দিয়েছি। হয়তো মেনেই নিয়েছি যে ওই আইসিসি ট্রফি আমাদের যোগ্য নয় । আমাদের আইপিএল আছে! কী হবে ওই আইসিসি ট্রফি জিতে? তার চেয়ে আইপিএল ঢের ভাল। যত মাতামাতি, প্রস্তুতি, সব আইপিএল কেন্দ্রিক। আজকাল তো আবার ঘরোয়া ক্রিকেটেও আমাদের মন নেই। কোন প্লেয়ার কত ভাল, কোন প্লেয়ার এর জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া উচিত সব কিছুর মাপ কাঠিই হল আইপিএল। শুধু একবার ভেবে দেখুন,তা নাহলে কি আর আমরা ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রস্তুতি আইপিএল খেলে নিতাম? অস্ট্রেলিয়া কিন্তু সে পথ মাড়ায়নি।
আরও শুনুন: এ কোন ‘অমৃতকাল’! সাক্ষী-ভিনেশরা মাটিতে পড়ে, মাটিতে মিশল দেশের সম্মানও
প্রিয় দলের হার দেখতে দেখতে যাদের ধৈর্য্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সবার একটাই প্রশ্ন, আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? একটা দল তত ভালো যারা ওপেনিং জুটি যত ভালো। তারাই তো দলের ভিতটা গড়ে। ইতিহাস ঘেটে দেখলেই এর প্রমাণ মিলবে , বিদ্ধংসি ওয়েস্ট ইন্ডিজ হোক বা অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়া, ওপেনিং জুটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভারতের যাবতীয় সাফল্যের নেপথ্যেও কিন্তু সেই ওপেনিং জুটির অবদান অনস্বীকার্য। কখনও শচীন-সৌরভ তো কখনও শচীন-শেহবাগ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, এখনকার ভারতীয় দলের ক্ষেত্রে সব থেকে নড়বড়ে জায়গাই হলো ওই ওপেনিং জুটি। ধোনি পরবর্তী যুগে ১০ বছরেও একটা স্থায়ী জুটি আমরা তৈরী করতে পারলাম না। এ দায় কার? ক্যাপ্টেনের? কোচের? না সিলেক্টরদের? দ্রাবিড়কে দোষারোপ করা হচ্ছে , বলা হচ্ছ, দ্রাবিড় অযোগ্য , কিন্তু এখন প্রশ্ন সত্যিই কি তাই?
ভালো করে খেয়াল করলে দেখেবন, দ্রাবিড় জুনিয়র টিমের কোচ থাকাকালীন ভারত একের পর এক উঠতি তারকা পেয়েছে। অথচ তিনি ভারতীয় দলের কোচ হিসেবে যোগ দেওয়ার পর আর কিন্তু সেরকম ভাবে কোনও নতুন প্লেয়ার কে আমরা পাচ্ছি না। সমস্যা ঠিক কোথায়? আচ্ছা দ্রাবিড় যে ভাবে তাঁর মনের মতো টিম খেলাতেন জুনিয়র টিমে, সিনিয়র টিমেও কি সেই ভাবে খেলাতে পারছেন? দিনের পর দিন পারফর্ম না করা প্লেয়ারদের বোঝা অযথা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে না তো? আসলে সমস্যা অনেক কিন্তু ওই যে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আসলে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা চোখে আঙুল দিয়ে বার বার দেখিয়েছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি । ধোনি তাঁর দলে নবীন খেলোয়াড়দের অগ্রাধিকার দিতে চেয়েছিলেন। সৌরভ, শচীন, সেহওয়াগ, দ্রাবিড়, লক্ষ্মণের প্রবীণ তারকাদের তিনি তাঁর টিমে রাখতে চাননি। ধীরে ধীরে উঠতি তরুণ তুর্কিদের নিয়ে টিম গড়তে চেয়েছিলেন। সেই সময় এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক জল ঘোলা হলেও তাঁর সেই সিদ্ধান্তের ফল কিন্তু আমরা দেখেছি তাঁর ট্রফি ক্যাবিনেটে। এমন কোনো আইসিসি ট্রফি নেই যেটা তিনি ভারতকে এনে দেননি। আর তাইতো তিনি ধোনি হতে পেরেছেন।
আরও শুনুন: মহেন্দ্র সিং ধোনি: প্রহরশেষের আলোয় দেখা ভারতীয় ক্রিকেটের অমোঘ সর্বনাশ
আর এখন কী হচ্ছে ? এখন দলের থেকেও ব্যক্তিত্ব বড় হয়ে ঊঠেছে। আর তাই তো দীর্ঘদিন পারফর্ম না করা সত্ত্বেও কিছু কিছু প্লেয়ার দিনের পর দিন সুযোগ পেয়ে চলেছেন। আচ্ছা জাতীয় দল নির্বাচন তো জাতীয় দল বা ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরমেন্স এর ভিত্তিতে হয়ে উচিত? যদি সত্যিই হত তাহলে কিন্তু অনেক রথী মহারথীরাই তাঁদের সিংহাসন হারাতেন। কিন্তু এই সব সমস্যা সমাধান করার ইচ্ছে বা চেষ্টা কোনোটাই কি টিম ম্যানেজমেন্ট এর আছে? একথা অনস্বীকার্য যে যেকোনো ট্রফি জিততে ভাগ্যের সহায়তা লাগে। অনেকেই তাই ধোনিকে ‘লাকি ক্যাপ্টেন’ এর তকমা লাগিয়ে দেন। তবে শুধুই যে ভাগ্য লাগে তা কিন্তু নয়। ট্রফি জিততে গেলে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত ও নিতে হয়। মাঠে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হয়, সে ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালের ৯৭ রানের ইনিংস হোক, বা শেষ ওভারে যোগিন্দরকে বল করানো, অথবা শেষ বলে কিপিং গ্লাভস খুলে আগে থেকে রান আউটের প্রস্তুতি। ট্রফি জিততে গেলে এক্স ফ্যাক্টর লাগে। যেটা দুৰ্ভাগ্যবশত এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না। না ব্যাটিং-এ, না বোলিং-এ। আর অধিনায়কত্বের কথা তো ছেড়েই দিলাম। যতই মুখে বলুন, ‘বিশ্বকাপে অন্য ভারতকে দেখা যাবে’, ভারতবাসীকে কিন্তু বিন্দুমাত্রও ভরসা দিতে পারছে না এই ভারতীয় টিম।
তাই রোহিত শর্মা, আপনি সান্ত্বনা দিচ্ছেন বটে, কিন্তু অনুরাগীরা ভরসা পাচ্ছে কই! আপনি কী করবেন আমাদের জানা নেই। তবে আমরা জানি, সোনার দিন ফেরাতে যে ঘাম ঝরানো প্রস্তুতি দরকার, তা এই মুহূর্তে নেই। বিশ্বকাপে ম্যাজিকটা তাহলে হবে কী করে! আপনি বলছেন বটে, তবে রোহিত শর্মা, আপনার জন্য চিন্তাই হয়, আর যাই হোক আপনি তো আর ধোনি নন!